বসিরহাটে তানিয়া পারভিন। তারপর মুর্শিদাবাদের আল কায়েদা যোগ। আর তার রেশ কাটার আগেই সীমান্তে পাচার নিয়ে নতুন তদন্ত। তিন ঘটনার কমন প্রথমত, বিদেশ যোগ। আর্থিক লেনদেন। কালো টাকা ও জঙ্গি যোগের সূত্র। একদিকে এন আই এ আর অন্যদিকে সিবিআই। এরপরে আরও অন্য তদন্ত সংস্থা যোগ দেওয়ার অপেক্ষা। গোটা ঘটনা প্রবাহে নজর রয়েছে সকলের। আমরাও ধারাবাহিক ভাবে চোখ রাখবো গোটা ঘটনাক্রম, তদন্তের অগ্রগতি ও ইতিহাসে। আজ প্রথম পর্ব।

কলকাতা ব্যুরো: এখন পর্যন্ত মালদা ও মুর্শিদাবাদ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে গরু পাচারের দুজন কমান্ড্যান্টের সরাসরি জড়িত থাকার খবর সামনে এসেছে। কিন্তু আরো কত সীমান্তরক্ষী বাহিনীর অফিসার এবং শুল্ক দফতরের অফিসার গরু পাচারের মদত দিয়ে মোটা টাকা ঘরে তুলেছেন, তার এখন হিসেব সবে শুরু হয়েছে।

নজরে বিএসএফ, শুল্ক কর্তা, পুলিশ, প্রভাবশালী

সূত্রের খবর, এখনো পর্যন্ত সিবিআই এই ঘটনায় অন্তত একডজন বিএসএফের অফিসার ও হাফডজন শুল্ক দফতরের অফিসারের সরাসরি জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছে। যদিও বাস্তবে এই তদন্ত কত দূর এগোবে তা নিয়েই প্রশ্ন তুলছে নানামহল। বিধানসভা ভোটের আগে একদিকে এনআইএ মুর্শিদাবাদের আল-কায়েদা জঙ্গী’ ধরার সঙ্গে সঙ্গেই সিবিআইয়ের গরু পাচারের এই তৎপরতায় অন্যরকম কিছু আছে কিনা সন্দেহ উঁকি মারছে তা নিয়েও। কেননা এ রাজ্যে গরু পাচারের ঘটনা জানে গোটা দেশ।
তবে সিবিআইয়ের এই নতুন করে নাড়া চাড়া এই চক্রের মূল অভিযুক্ত এনামুল হকের কাছে আগেই ছিল কিনা, তা নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। কারণ গরু পাচারে এর আগেও ধৃত এনামুলের ‘কালো’ জগতের বাইরে একটা পরিচয় তৈরি হয়েছে গত কয়েক বছরে। চাল, কয়লা সহ অন্য বেশকিছু সামগ্রীর আমদানি- রপ্তানির ব্যাবসা তার। সম্প্রতি বহুল প্রচারিত বিজ্ঞাপনের এক রডের ব্যবসাও খুলে ফেলেছে গরু পাচারের এই অভিযুক্ত। এই ব্যবসার মধ্যে কতটা ‘কালো’ আর কতটা সাদা, সে ব্যাপারে অবশ্য খুব বেশি মুখ খুলছেন না তার ঘনিষ্ঠরা। সিবিআই এখন তার সেই কলকাতায় ‘সাদা’ ব্যবসার খোঁজখবর নিতে শুরু করেছে।

এনামুলের সাদা কালো সাম্রাজ্য

কিন্তু কলকাতার প্রাণকেন্দ্র ডেকার্স লেন এলাকায় তার সাদা ব্যবসা দেখভালের অন্যতম ম্যানেজার গত মাস দেড়েক ধরে ‘ নিখোঁজ।’ মুর্শিদাবাদের লালগোলায় এনামুলের আদি বাড়ি কুলগাছির ছেলে, সেই ম্যানেজার আবার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় তার। তিনি সামলাতেন এনামুলের কলকাতার ব্যবসাপত্র। গত জুলাই মাসের শেষে তিনি পরবের জন্য গিয়েছিলেন দেশের বাড়ি। গত বেশ কিছুদিন ধরে তিনি সেখানেই ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ দিন দশেক আগে থেকে তাকে আর এলাকায় দেখা যাচ্ছে না বলে খবর। আবার তাকে কলকাতার এনামুলের অফিসেও এর মধ্যে দেখেননি কেউ। এই অবস্থায় এনামুলকেও বেশ কিছুদিন ধরেই মুর্শিদাবাদ ও তার গত বছর দেড়েকের নতুন ব্যবসা কেন্দ্র মোরগ্রাম এলাকায় চোখে পড়েনি তেমনভাবে কারোর। ফলে ঘনিষ্ঠ আত্মীয় তথা ম্যানেজারকে নিয়ে এনামুল এখন ভিনদেশে গা ঢাকা দিয়েছেন কিনা তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে।

বিএসএফের কমান্ডেন্ট এবং এনামুলসহ চারজনের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করে দেশজুড়ে তল্লাশির পরে বুধবার রাতের বেলায় সিবিআইয়ের একটি টিম হানা দেয় লালগোলার কুলগাছি গামে। যদিও বহু বছর ধরেই এনামুল আস্তানা গেরে ছিল লালগোলা বাজার এলাকায়।

কুলগাছি থেকে কলকাতা

আদি বাড়িতে তার যাতায়াত ছিল যথেষ্ট। এমনকি গঙ্গার ধারে তার সেই গ্রাম একটা প্রায় দুর্গ সমান। যেখানে দিনের বেলাতেও নাকি পুলিশ অপরাধী ধরতে ঢুকতে ভয় পায়। ফলে যে কোনো ঝড়-ঝামেলা হলেই নিজের আদি বাড়ির এলাকায় ঢুকে পরা ছিল তার পুরনো অভ্যেস। যদিও বুধবার গভীর রাত পর্যন্ত কুলগাছিতে সিবিআই থাকলেও, তেমন কাউকে সেখান থেকে তুলে আনার বা কোন জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করার খবর নেই।

কেরালা যোগে বাড়তি নজর

২০১৮ সালে জানুয়ারি মাসে কেরালা থেকে ধৃত বিএসএফ কমান্ড্যান্ট মেসোর থেকে ৪৫ লক্ষ টাকা উদ্ধার করার পর সিবিআই সেই ঘটনায় গ্রেপ্তার করেছিল এনামুলকে। যদিও কিছুদিন পরে দুজনে জামিন পেয়ে যায়। প্রাথমিক তদন্তে সিবিআই আদালতকে জানিয়েছিল, বিএসএফের মালদা ব্যাটেলিয়ানের কমান্ড্যান্ট হিসেবে দায়িত্বে থাকার সময় এনামুলদের পাচারে সহায়তা করার জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ শুধু নয়, মাদক থেকে শুরু করে আগ্নেয়াস্ত্র পাচারের অভিযোগ সিবিআইয়ের।

বছরে বিশ হাজার কোটির গরু পাচার রাজ্য দিয়ে

সিবিআই প্রাথমিক একটি হিসেবে দেখিয়েছিল, এ রাজ্যের সীমান্ত দিয়ে বছরে শুধু গরু পাচারের ক্ষেত্রেই কুড়ি হাজার কোটি কালো টাকার ব্যবসা চলে। আর এর একটা বড় অংশ বিএসএফ, শুল্ক দফতর, পুলিশ থেকে শুরু করে প্রভাবশালীরা, এমনকি সাংবাদিকদেরও পকেটে যায়। ফলে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের এই চোরাবাজার এক কথায় রাজ্যে বিপুল কালো টাকার জন্ম দিচ্ছে।

আতিকের খোঁজ

এনামুলের বাড়বাড়ন্তে এখন আরো একজনের খোঁজে সিবিআই এর দুদে গোয়েন্দারা। হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন আতিক নামের কোনও এক ব্যক্তিকে। কলকাতার বেকবাগান -তোপসিয়া এলাকার এই আতিক নাকি এনামুলের কলকাতায় প্রভাবশালীদের সঙ্গে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। আবার তার অন্যতম মেন্টর বলেও আতিককে চিহ্নিত করছে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। তার ঘনিষ্ট রাও জানে, আতিকের প্রভাব এনামুলের উপরে। ফলে এনামুলকে পাকড়াও করতে বা তার অন্ধকার জগত সম্পর্কে আরও খোঁজ পেতে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার কাছে আতিক একটা বড় অস্ত্র হতে পারে বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা।

(চলবে)

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version