কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ থেকে শুরু করে তথ্যপ্রযুক্তির যুগেও রথ কথাটির বহুল ব্যবহার রয়েছে। ‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগণে’র বর্ষায় হয় রথের মেলা। ধর্মীয় চেতনার বাইরেও মেলার সঙ্গে যোগ হয় সামাজিক ও লৌকিক আচরণ। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘উপলক্ষ যাই হোক না কেন, বাঙালির সকল উৎসবের মধ্যে একটা সর্বজনীন রূপ আছে। এতে ধর্ম, সম্প্রদায়, জাত-পাত বা ধনী-গরিবের সামাজিক বিভক্তি বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। বরং সকল শ্রেণির মধ্যে সেতুবন্ধন রচিত হয়।’রথযাত্রার মতো লোক উৎসব তেমনই এক উৎসব।  আষাঢ় মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়ায় রথযাত্রার ধারাটি নীলাচল থেকে বাংলায় প্রচলন করেন শ্রী চৈতন্যদেব । যাকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু ঐতিহ্যশালী রথযাত্রা এই পবিত্র দিনে অনুষ্ঠিত হয়।

রাজ পরিবারের কুলদেবতা মদনমোহন দেবের রথযাত্রা ঘিরে জনজোয়ারে মাতে কোচবিহার। এই রথটি মদনমোহন মন্দির থেকে বিশ্বসিংহ রোড, মীনাকুমারি চৌপথী, এনএন রোড ঘুরে রাজবাড়ি লাগোয়া কেশব রোড ধরে গুঞ্জবাড়ি পৌঁছয়। সেখানে ডাঙ্গার-আই মন্দির চত্বরের এক মন্দিরে উল্টো রথের আগের রাত পর্যন্ত বিগ্রহ রাখা হবে। কোচবিহার দেবোত্তর ট্রাষ্ট বোর্ড থেকে জানা যায়, “ঐতিহ্যের কথা মাথায় রেখে এই আয়োজন। রথযাত্রা উপলক্ষে গুঞ্জবাড়িতে সপ্তাহব্যাপী মেলা হয়।

অন্যদিকে কোচবিহার জেলার দিনহাটার শ্রীগুরুপ্রসন্ন আশ্রমে রথযাত্রার আনুষ্ঠানটি হয় যথাবিহিত নিয়মে। পঞ্জিকা মেনে ‘স্নানযাত্রার’ দিন সংকীর্তন-সহ শহর অতিক্রম করে ফুলের মালা, আম্রপল্লব শোভিত কলসি করে জল নিয়ে আসা হয় স্থানীয় দিঘি থেকে। নাটমন্দিরের স্নানবেদিতে বসানো হয় জগন্নাথ দেবকে। দারুমূর্তিতে মাখানো হয় ঘি, মধু, দধি, দুগ্ধ। তারপর কলসির জল ও ভক্তদের আনীত ঘটের জল-সহ ১০৮ কলসি জল দিয়ে স্নান করানো হয় জগন্নাথকে। বিশেষ পুজোপাঠের পর বন্ধ হয়ে যায় জগন্নাথ দর্শন। রথযাত্রার আগের দিন অনুষ্ঠিত হয় ‘গুন্ডিতামন্দির মার্জন শীল’ পক্ষকাল ধরে ভক্তদের সামনে দর্শন দেন জগন্নাথ তাই একে মত্রোৎসব-ও বলা হয়ে থাকে। পর দিন রথযাত্রা উপলক্ষে বিশেষ পুজোপাঠের পর বিকেলে নয়টি চূড়াবিশিষ্ট কাঠের রথে আরোহণ করেন জগন্নাথ। নামসংকীর্তন বাদ্যবাজনা-সহ ভক্তদের রথের রশির টানে শহর পরিক্রমা করেন মহাপ্রভু জগন্নাথ।

হলদিবাড়িতে বাংলার ১৩৭৯ সালে  হলদিবাড়ির জনৈক হরিদাস বণিকের গৃহদেবতা রাধাকৃষ্ণ ও গোপাল সারথী-সহ রথাযাত্রার আয়োজন করে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বু্দ্ধপূর্ণিমা তিথিতে ‘পুষ্পরথ’ নামে রথযাত্রা শুরু হয়। পরের বছর হলদিবাড়ির পক্ষে রথ নামে আষাঢ় মাসে জগন্নাথদেবের রথ যাত্রার দিন। আজও হরিদাস বণিকের বাড়ি থেকেই রথটি বের হয় এবং হলদিবাড়ি পরিক্রম করে স্থায়ী দয়াময় বণিকের বাড়িতে সাত দিন অবস্থান করে। এই রথযাত্রার জাতিধর্ম নির্বিশেষে মানুষ অংশগ্রহণ করেন ও রথের রশিতে হাত লাগান। পাশাপাশি হলদিবাড়ির বালাভাণ্ডার শিমূলতলার রথযাত্রা। সূচনা হয় বাংলার ১৩৭২ সালে। দুলালচন্দ্র সরকারের উদ্যোগে।। পরবর্তী কালে তাঁর পুত্ররা এই রথযাত্রাটি পরিচালনা করে আসছিল। প্রধান আকর্ষণ জিলিপি।

শলাবাজারের নেতাজি কলোনির স্বর্গীয় দিনেশচন্দ্র সূত্রধরের উদ্যোগে পারিবারিক রথযাত্রার সূচনা হয়। বর্তমানে এই রথযাত্রার যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করে শল পুরসভা। প্রায় ২৫ ফুট উঁচু কাঠের রথটির সামনে রয়েছে দুটে কাঠের ঘোড়া ও দণ্ডায়মান সারথি। রথকে কেন্দ্র করে মেলাটি বসে স্থানীয় আর আর স্কুল ময়দানে। রাঙামাটি, শলারকাঁটা, নিদান মেটেলি নিউ গ্ল্যাসকো চা বাগানের শ্রমিক কর্মচারীরা মেলা দেখতে যান।

বর্ষাস্নাত মেঘমেদুর আকাশ আর সজল ধরিত্রী পল্লবিত হয় ঘন সবুজে আর আনন্দ অনুষ্ঠানের আবেশে। কামিনী, চাঁপার মিষ্টি সুবাসে রথের মেলার জিলেপি আর পাঁপড় ভাজার গন্ধ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। শিশু-কিশোর এই দিনটির জন্য অধীর অপেক্ষায় থাকে। বড়দের রথের অনুকরণে পাড়ায় পাড়ায়, অলিতে গলিতে শিশু-কিশোরদের রথ টানা পরিচিত দৃশ্য আজও দেখা যায়। একদা রথের মেলা থেকে কেনা বিভিন্ন খেলনাতে ঘটত সমাজের সব কিছুর প্রতিফলন। শিশু-কিশোর বেলা বেড়ে উঠত রথের মেলা দেখতে দেখতে। খেলনাপাতি, রকমারি কাঠের পুতুল অর্থাৎ বড়দের সংসারের অনুকরণে বাসনকোশন সহ আরও কত কী! কিন্তু বর্তমানে মহার্ঘ খেলনার জঞ্জালের পাহাড়ে হারিয়ে যাচ্ছে না তো মাটির গন্ধমাখা স্বপ্নময় প্রতিফলনের খেলনা সম্ভার? কিংবা মা ঠাকুমার অনুকরণে পুতুলদের মাতৃস্নেহে মাতৃদুগ্ধ দিয়ে ঘুমপাড়ানির আধো আধো সঙ্গীত। মনোজগতের মহার্ঘবোধগুলি অঙ্কুরিত হয় নির্ভেজাল নিষ্কলুষ মাটির গন্ধমাখা মেলা থেকেই।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version