(প্রথম পর্ব)

কৌশিক সরকার

ঘরের বাইরে থেকে তালা দেওয়া। দরজার বাইরে জমে রয়েছে ধুলো, নোংরা। তবু নাম ধরে ডাকাডাকি চললো। কিন্তু সাড়া নেই কোনও। কেউ বাড়িতে থাকে না বলেই মনে হচ্ছে।
বাঁকুড়া পুলিশের দলটি তখন ‘পাখি উড়ে গিয়েছে’ ভেবে হতাশ। ভোপাল পুলিশ আর কোনো সাহায্য যে করবে না তা ততক্ষণে বুঝে গিয়েছে এই দল। কিন্তু দলের একজন তখন হাল ছেড়েও বাড়ির আশপাশে ঘুরছিলেন। একটু ভালো করে নজর করতেই খটকা লাগলো তাঁর। বাড়িতে কেউ না থাকলে বাথরুমের থেকে যে জলের পাইপ বাইরে বেরিয়ে এসেছে , তা তাহলে ভেজা কেন? এবার সকলে নজর দিলেন সেদিকে। ঠিকই তো। সেই ভেজা পাইপ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, সদ্য কেউ বাথরুম ব্যবহার করেছে। কিন্তু কি করে! বাইরে থেকে তো ঘরে তালা।
সঙ্গে থাকা ভোপাল পুলিশের কনস্টেবলের যেন কোনো তাপ উত্তাপ নেই। এক তরুণীকে অপহরণের অভিযোগে অভিযুক্তকে গ্রেপ্তারের জন্য বাঁকুড়ার পুলিশ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে ভোপাল পৌঁছেছে। কিন্তু ভোপাল থানা তা মানতে রাজি নয়। কারণ যে মেয়ে অপহরণের অভিযোগ বাঁকুড়া পুলিশ তুলছে, তিনি মাস খানেক আগে নিজেই থানায় চিঠি দিয়েছেন। জানিয়েছেন, বাড়ির অমতে বিয়ে করায় তা মানতে পারছে না পরিবার। তাই তাঁরা এসে তাঁর স্বামীকে হেনস্থা করতে পারে।


ফলে সেই চিঠি পাওয়ার পর মেয়েটির বাবা-ভাই যখন সাকেতনগর এসেছিলেন তখন চিঠির বক্তব্য আরও বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় থানার। ফলে তখন প্রায় ঘাড়ধাক্কা দিয়েই তাঁদের বিদায় করেছিল গোবিন্দপুরা থানা। কিন্তু তার আবার মাসখানেক পরে আবার বাঁকুড়া পুলিশ সেই মামলাতেই কোর্টের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আনলেও তাতে খুব একটা আমল দিতে চায়নি পুলিশ। শেষ পর্যন্ত ইন্সপেক্টর অমিতাভ কোনার কোর্ট অর্ডার পালন না করায় কোর্টে টেনে নিয়ে যাওয়ার ভয় দেখান। তাতেই কিছুটা ভয় আর বিরক্তি নিয়ে ওই কনস্টেবলকে সঙ্গে দেয় দলটির। ফলে বাঁকুড়া পুলিশের দল হতাশ হলেও তাতে হেলদোল নেই। উল্টে খুশিই সেই কনস্টেবল।
কিন্তু কপাল খারাপ তাঁর। বাথরুমের ভিজে পাইপের সূত্র পেয়েই বাঁকুড়া পুলিশের স্পেশাল অপারেশন গ্রুপের ওসি সন্দীপ ব্যানার্জি পাঁচিল বেয়ে উঠে পড়েন কার্নিশে। ঘরের ঘুলঘুলিতে চোখ রেখে তাঁর ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার অবস্থা। ঘরের ভিতরে একটা ছায়া স্পষ্ট। ঘরের কোণে বসে আছে কেউ। ডাকাডাকিতেও চুপ।
তখন বাইরে থেকে ফের কল করা হলো মোবাইলে। ঘুলঘুলিতে চোখ রেখে দেখলেন, সাইলেন্ট করা ফোন। কল আসায় শুধু তার আলো জ্বলছে আর নিভছে।

এবার নিশ্চিত তদন্তকারীরা। ডাকাডাকিতেও দরজা না খোলায় এবার তা ভাঙার তোড়জোড় শুরু হলো। কিন্তু এর চাপ রাখতে না পেরে দরজা খুলে দিল ভিতরের লোক। ঘরের ভিতরে কোনো সুস্থ মানুষ বাস করে মনে হলো না। বাইরে থেকে আনা খাবারের অংশ, না ধোয়া থালা বাটি, মেঝেতে নোংরার স্তুপ-তদন্তকারীদের চোখের সামনে যেন ভেসে উঠলো কলকাতার রবিনসন্স স্ট্রিটের সেই বাড়ি। যে ঘরে পার্থ দে মাস ছয়েক ধরে দিদির দেহ আগলে নোংরার মধ্যে বসেছিলেন, যেন তারই ছবি। শুরু হলো জেরা। উদয়ন জানালো আকাঙ্ক্ষা আমেরিকায় আছে।
এরইমধ্যে যে অফিসার বাঁকুড়ায় বসে প্রথম অভিযোগ হওয়ার পর তৎকালীন পুলিশ সুপার সুখেন্দু হীরাকে আকাঙ্ক্ষা ও উদয়নের মোবাইল ট্র্যাক করে সন্দেহজনক কিছুর ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, সেই এসওজি এবং ওসি সাইবার সন্দীপ ব্যানার্জি ঘাঁটা শুরু করলেন উদয়নের মোবাইল। কনস্টেবল জয়ন্ত নাগ তন্নতন্ন করে খুঁজে ঘড় থেকে পায় আকাঙ্ক্ষার মোবাইলটিও।
আমেরিকায় আকাঙ্ক্ষা কবে গেছে, কোথায় আছে তা নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের ফাঁকেই দলের মহিলা কনস্টেবল সুমিত্রা মালের নজর পড়লো একটি ট্রাভেল ব্যাগের উপর। ঘরের কোণ থেকে সেই ব্যাগ বের করে ঘাটাঘাঁটির মধ্যেই মেয়েদের জামা-কাপড়ের সঙ্গেই বেড়িয়ে এলো আকাঙ্ক্ষার পাসপোর্ট।


ব্যাস। দল নিশ্চিত এতদিনের আমেরিকার গল্প মিথ্যে। এবার জেরা শুরু হলো, তাহলে কোথায় আকাঙ্ক্ষা? কিন্তু কিছুতেই স্পষ্ট করে কিছু বলছে না উদয়ন। মামলার তদন্তকারী অফিসার কৌশিক হাজরা সহ অন্যদের অনেকক্ষন থেকে অস্বস্তি হচ্ছিল, ঘরের মধ্যে একটা উঁচু বেদী দেখে। ঘরের মধ্যে বেখাপ্পা বেদীর উপর টিভি সেট বসানো কেন? সবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল এই একটা প্রশ্ন। কিন্তু কেউ হয়তো কল্পনাতেও আনতে পারেননি।
তাঁরা জেরা চালালেন আকাঙ্ক্ষার হদিশ পেতে। ঘরে এমন একটা উঁচু বেদী কেন? সে প্রশ্নেও উদয়ন সেটা তার ধ্যানবেদী বলে জানালো। কিন্তু তার উপর টিভি কেন তার অবশ্য স্পষ্ট জবাব এলো না। ওই ঘরে বসেই তখন টানা প্রশ্নের পর প্রশ্নে একসময় ভাঙলো উদয়ন।
ওই বেদীর নিচেই আছে আকাঙ্ক্ষা। উদয়ন ইঙ্গিত করতেই বাকরুদ্ধ সকলে। দুপুর ১২ টা নাগাদ যে অপারেশন শুরু হয়েছিল এতক্ষনে ঘড়ির কাটা রাত আটটা ছড়িয়েছে। আর গোবিন্দপুরা থানার যে কনস্টেবল এতক্ষন ‘স্রেফ বকওয়াস’ ভেবে গা এলিয়ে ছিলেন, তাঁরও এবার মেরুদন্ড সোজা হলো। খবর গেল থানায়। এবার আর কোনও এড়িয়ে যাওয়া নয়। বাঁকুড়া পুলিশ রাতেই ওই বেদী ভাঙার সিদ্ধান্ত নিলো। ফলে স্থানীয় পুলিশ জোগাড় করে আনলো মিস্ত্রি। ভাঙা হলো বেদী।
উদ্ধার হল একটি লোহার ট্রাঙ্ক। তা খুলতেই বেরোলো হাত-পা মোড়া একটি দেহ।
ওই অবস্থায় তথ্য-প্রমাণ এবং অভিযুক্তকে নিয়ে মাঝ রাতে স্থানীয় থানায় ফিরলো বাঁকুড়া পুলিশ। তখন অবশ্য গোবিন্দপুরা থানার নিজেদের উন্নাসিকতায় লজ্জিতও।

                             (চলবে)

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version