গাজা-ইসরায়েলের রক্তাক্ত সংঘাতের এক মাস পূর্ণ হল। গত ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের সশস্ত্র সংগঠন হামাস ইসরায়েলে হামলা চালানোর পর থেকে গাজায় ক্রমাগত পাল্টা আক্রমন করতে থাকে ইসরায়েল।গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি হামলা এতোটাই তীব্র রূপ নেয় যে, গত এক মাসে ওই উপত্যকায় যত হতাহত হয়েছে তা ২১ মাসে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের হতাহতের সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। হামাসের হামলার পর থেকে ইসরায়েলের অব্যাহত বিমান হামলায় এখনো পর্যন্ত ১০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। সব মিলিয়ে এক চরম মানবিক বিপর্যয়ের মুখে রয়েছে গাজার লক্ষ্য মানুষ। হামলা থেকে বাঁচতে সবাই দক্ষিণের পথে পা বাড়ালেও জাতিসংঘ বলছে গাজার কোন জায়গায়ই নিরাপদ নয়।

গাজা উপত্যাকায় ইসরায়েলি হামলায় এক মাসে  নিহত হয়েছেন ১০০২২ জন। এর মধ্যে ৩১০৪ জন শিশু ও ২৬৪১ জন নারী।  গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিহতের এই সংখ্যা জানায়। জাতিসংঘ ত্রাণ ও সংস্থাপন সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউএ) এক্স-এ দেওয়া এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, গাজায় প্রতি ১০ মিনিটে  ১টি শিশু নিহত ও ২টি শিশু আহত হচ্ছে।   গাজায় ইসরায়েলি হামলার আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার প্রধানরা এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘যথেষ্ট হয়েছে অবিলম্বে গাজায় মানবিক যুদ্ধবিরতি চাই’। যুদ্ধবিরতির জন্য ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক চাপ প্রত্যাখ্যান করে ইসরায়েল বলেছে, ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরায়েলে হামলার সময় হামাসের হাতে আটক জিম্মিদের আগে মুক্তি দিতে হবে। ওই হামলায় ১৪০০ ইসরায়েলি নিহত ও জিম্মি হিসেবে আরও দুই শতাধিক আটক হয়েছে।

জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার প্রধানরা এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন, ‘একটি পুরো জনগোষ্ঠী অবরুদ্ধ এবং হামলার মুখে রয়েছে। বেঁচে থাকার জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে। তাদের বাড়ি, আশ্রয়কেন্দ্র, হাসপাতাল এবং মসজিদে বোমা হামলা করা হয়েছে। এটা একেবারে গ্রহণযোগ্য নয়। অবিলম্বে মানবিক যুদ্ধবিরতি দরকার। ৩০ দিন হয়ে গেছে। যথেষ্ট হয়েছে। এই যুদ্ধ এখনই বন্ধ করা উচিত’। ইউএনআরডব্লিউএ পরিচালিত গাজার স্কুলগুলোতে বর্তমানে ৬ লাখ ৭০ হাজার বাস্তচ্যুত ফিলিস্তিনি আশ্রয় নিয়েছেন। এক মাস আগে ইসরায়েলি হামলা শুরুর পর এই সংস্থাটির অন্তত ৭০ কর্মী নিহত হয়েছেন। হামলা ও বিপুল হতাহতের শিকার ক্ষদ্র ভূখন্ড গাজা উপত্যাকাকে পুরোপুরি অবরুদ্ধ করে রেখে অবিরাম নৃশংস হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। সেখানকার ২৩ লাখ মানুষকে পাণীয় জল-ওষুধ-বিদ্যুতের মতো মৌলিক সব পণ্য থেকে বঞ্চিত রেখে নৃশংস হামলা ও গণহত্যা চালাচ্ছে দখলদার ইসরায়েলি বাহিনী।

গাজায় ইসরায়েলি বোমা হামলায় প্রতি ১৫ মিনিটে একজন শিশু নিহত হচ্ছে। এ তথ্য জানিয়েছে একটি ফিলিস্তিনি এনজিও। হামাসের হামলার পাল্টা জবাবে গত ৭ অক্টোবর থেকে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েল বোমা হামলা চালাচ্ছে। চলমান এই হামলায় প্রতিদিন একশোরও বেশি শিশু নিহত হয়েছে।  গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ২২ অক্টোবর জানিয়েছেন, ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলি বোমা হামলায় ৫,০৮৭ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে; এরমধ্যে রয়েছে ২,০৫৫ শিশু। দ্য ডিফেন্স ফর চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনাল-প্যালেস্টাইন (ডিসিআইপি)-র একজন মুখপাত্র বলেছেন, “আমরা বাস্তবে একটি গণহত্যা প্রত্যক্ষ করছি।” এমনকি ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় নিহত ১৪০০ ইসরায়েলির মধ্যে কমপক্ষে ১৪ শিশু রয়েছে বলে জানা গেছে। হামাসের হাতে বন্দী প্রায় ২০০ জনের মধ্যেও শিশু রয়েছে। তবে, ইসরায়েল হামাসের হামলায় নিহত সবার তথ্য প্রকাশ করেনি।

প্রশ্ন শিশুরা কি যুদ্ধে আইনতভাবে সুরক্ষিত নয়? হ্যাঁ। আইনতভাবেই শিশুরা যুদ্ধে সুরক্ষিত। ১৯৪৯ সালে জেনেভা কনভেনশনের অধীনে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সশস্ত্র সংঘাতের বিধি পাস করা হয়। এতে বলা আছে, যুদ্ধের সময় শিশুদের সুরক্ষিত রাখতে হবে এবং তাদের সাথে মানবিক আচরণ করতে হবে। হলোকাস্টের সময় ইউরোপে দেড় মিলিয়ন ইহুদি শিশু নিহত হওয়ার মাত্র দুই বছর পর ইসরায়েল ১৯৫১ সালে কনভেনশনের বিধিগুলোর স্বীকৃতি দেয় করে। কিন্তু ইসরায়েল ৪র্থ জেনেভা কনভেনশনকে স্বীকৃতি দেয় না। ৪র্থ কনভেনশনে দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াইরত বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার কথা বলা আছে। ইসরায়েল ফিলিস্তিনকে দখলকৃত ভূমি বলে মনে করে না। গাজায় সামরিক শক্তির অসম ব্যবহারকে ইসরায়েল হামাসকে ধ্বংস করার একটি বৈধ উপায় হিসেবে বিবেচনা করছে। আর তাই হামলায় শিশুসহ বেসামরিক মানুষের মৃত্যু যুদ্ধাপরাধ নয় বলে দাবি ইসরায়েলের।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version