%%primary_category%%

ঘুরে-ট্যুরে

হাতের নাগালে অচেনা জগৎ হেনরি আইল্যান্ড

By admin

July 25, 2020

প্রসঙ্গটা উঠলো এক উইক এন্ডের চায়ের আড্ডায়।অনেকদিন কোথাও যাওয়া হয় নি। গরমের ছুটি চলছে বাচ্চাদের স্কুলে, তাই দুম করে একটা কোথাও বেড়িয়ে এলেই হয়। আড্ডাটা চলছিল আমাদের কলেজের প্রাক্তনীদের বেড়ানোর একটা গ্রুপেই। নারী, পুরুষ,বাচ্চা, বুড়ো থেকে শুরু করে হালে পাশ করা ফচকে ছোঁড়াও তার সদস্য। ওখানে বসেই ফোনে ফোনে খোঁজ খবর নেওয়া শুরু হল। ঠিক হল পরের উইক এন্ডের আড্ডা বসবে হেনরি আইল্যান্ডে ।হেনরি আইল্যান্ড দক্ষিণ ২৪ পরগনার অন্তর্গত একটা দ্বীপ। যা একহীন গড়ে উঠেছে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবেও।যেমন কথা তেমন কাজ।

শনিবার ভোরে আমাদের ২৬ সিটের ট্যাভেলার রওনা দিল কলকাতা থেকে । সাকুল্যে ২২ জনকে নিয়ে যদিও তার মধ্যে বেশ কিছু কুচো কাঁচাও আছে।আমাদের টিম লিডার সুমিতদা একদম সামনের সিটে বসে। মাথায় একটা মেক্সিকান হ্যাট আর চোখে রোদ চশমা। দেখে মনে হচ্ছে যেন হেনরি সাহেবই চলেছেন আমাদের সাথে। আর আমরা চলেছি তার খাস তালুকে । শিয়ালদা স্টেশন থেকে নামখানা লোকালে নামখানা নেমে বাসে চেপেও পৌঁছানো যায় জেটিঘাট বাসস্টপ, সেখান থেকে ভ্যান বা টোটোতে চেপে চলে আসা যায় হেনরি আইল্যান্ড ।সারা রাস্তা হৈ হৈ করতে করতে মাঝে প্রাতরাশ, চা এবং বিয়ার কেনার বিরতি নিয়েও আমরা ১১ টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম আমাদের গন্তব্যে। গাড়ি রাখার একটা খোলামেলা জায়গা, যার ঠিক সামনেই ওয়াচ টাওয়ার। আর বাঁ হাতে পশ্চিমবঙ্গ মৎস্য দপ্তরের পর্যটন অফিস। ওয়াচ টাওয়ারের গা ঘেঁষে আইল্যান্ডে ঢোকার মেন গেট, যা খোলা থাকে সকাল ৬টা থেকে বিকেল ৬টা। এই গেট টপকে সোজা রাস্তা ম্যানগ্রোভ অরন্যের মধ্যে দিয়ে শেষ হয়েছে সমুদ্র সৈকতে।

বাইরে তখন নিদারুণ গরম। তার আগে এতক্ষণের এসি বাসে স্বর্গের অনুভূতি । হাতে বল নিয়ে বাস থেকে নেমেই, ঈশান বলটা ঢুকিয়ে দিল ওয়াচ টাওয়ারের মধ্যে । তালা বন্ধ, মুখ কাঁচুমাচু করে মায়ের বকা খেয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। ঈশানের বাবা,মানে আমাদের সৌমেন্দু অন লাইন এক্সপার্ট। অন লাইন বুকিং কনফার্ম করতে ঢুকেছে পর্যটন অফিসে আর বার বার মাথা বের করে এক এক জনের আইডেন্টিটির প্রমান পত্র চাইছে। সেই ফাঁকেই সুমিতদা সঙ্গে আমি অফিস টপকে সটান পৌঁছে গিয়েছি রান্না ঘরে। এত গুলো মানুষের দুপুরের খাবারের আয়োজন করতে হবে, দাম দস্তুর করে এবং প্রয়োজন অনুসারে রান্নার বায়না করা হল। ওদিকে সৌমেন্দু কাগজের কাজ শেষ করেছে। অনেকে ব্যতিব্যস্ত হলো ঘরে যাবার জন্যপশ্চিমবঙ্গ মৎস্য দপ্তরের তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠেছে এই পর্যটন কেন্দ্র । হেনরি আইল্যান্ডের মধ্যে থাকার জায়গা সবই মৎস্য দপ্তরের এবং সব কটাই ঝুলনের মতো সাজানো কটেজ। আমাদের ৮ টা ঘর বুক করা ছিল।ভাবতে পারি নি তাতে আস্ত একটা বাড়ি পেয়ে যাবো। হেনরি আইল্যান্ডের গেট অতিক্রম করলে, পাওয়া যাবে বিশাল বিশাল জলাশয় বা ঝিল।সেখানে মাছ চাষ হয়।প্রতিদিন সকালে মাছ ধরাও হয় সেখানে। সেই “ঝিল কে উসপার” আমাদের বাড়ি, চিহ্নিত হল। তবে আনন্দের বিষয় এটাই, একটা গোটা বাড়ি আমাদের, যার চৌহদ্দির মধ্যে আমরা ছাড়া আর কেউ নেই ।

ঈশানের বল উদ্ধারের পর এবার আমরা সবাই চললাম ‘আমাদের বাড়ি’র উদ্দেশ্যে।ঝিল পেরিয়ে একটা বাঁশের সাঁকো টপকে আমাদের বাড়ি! কি অসাধারণ!প্রশান্ত সুন্দর সাজানো যথেষ্ট আধুনিক আয়োজন।বাড়ির সামনে দাঁড়ালে তিন দিকে ঝিলের বিস্তার, মাছরাঙা পাখি,গঙ্গা ফড়িং এক্কা দোক্কা খেলছে অবিরাম। চিলের দল ছোঁ মেরে তুলে নিচ্ছে মাছ চোখের নিমেষে । চিলড বিয়ারে চুমুকের সঙ্গে এসব দেখতে দেখতে , স্নান সেরে হাজির হলাম মধ্যাহ্ন ভোজে । হেনরি আইল্যান্ড যেন মাছের সাজানো বাগান । পারশে , পাবদা, ভেটকি দিয়ে সাজিয়ে আনা হলো গরম ভাতের থালা। জানি এর পেছনে সুমিতদার হাত বা মাথা দুটোই আছে,কিন্তু বললে পারি – এ এক অনন্য সাধন, যা মনে থাকবে আজীবন ।

ক্লাইম্যাক্সকে বাঁচিয়ে রেখেছি বিকেলের জন্য । তাই খেয়ে দেয়ে, একটু বিশ্রাম নিয়ে ঠিক ৫ টার পর ঠিক করলাম এবার যাবো সমুদ্র দেখতে। সে অনুযায়ী রওনা হলাম। মূল ভূখণ্ড থেকে দ্বীপটিকে আড়াল করে সুন্দরী, গেওযা, ক্যাওড়ার ম্যানগ্রোভ অরন্য। অরন্যের মধ্যে দিয়ে সরু হাঁটা পথ, যা উন্মুক্ত হয়- শান্ত সমুদ্র তটে । সমুদ্রতটের বালি এখানে সাদা এবং চিকন। দিগন্ত প্রসারী শান্ত সমুদ্রের মাঝে আস্তে আস্তে জলের কোলে সে দিনের মতো মাথা ডোবালেন সূর্যদেব। সে এক অসাধারণ দৃশ্য । মধুমিতার ছেলেটা সব চেয়ে ছোট। বছর চারেক বয়স হবে। লাল কাঁকড়া ছড়িয়ে আছে সারা সৈকত জুড়ে। তাদের পেছনে ধাওয়া করতে করতে,তাদের সাথে লুকোচুরি খেলতে গিয়ে সারা গায়ে মেখেছে বালি।হেনরি আইল্যান্ডে সমুদ্রে স্নান করা মানা,কারন যত্রতত্র ছড়িয়ে আছে চোরাবালি। জলে পা ভেজানো অব্দি চলতে পারে, তার বেশি নয়। কোস্টাল গার্ডরা সদা সচেতন এই ব্যাপারে । সন্ধ্যা ৬ টা বাজলেই খালি করে দিতে হবে সমুদ্রের ধার। তাই আমরাও ঘরে ফেরার পথ ধরলাম।

ততক্ষণে আলো জ্বলে উঠেছে কটেজ সংলগ্ন সমস্ত জলাধারের পাশে। আছে একটা ছোট্ট পার্ক, সাজানো গোছানো । সন্ধ্যার চা খাওয়া ওখানে বসেই সারা হল।এরপর শুরু হল আড্ডার আসর। বৈশালীর গান, চিরন্তনদার মজার মজার ঘটনা সঙ্গে সুমিতদার আয়োজনে ভেটকি মাছ ভাজা।কোথা দিয়ে যে সময় বয়ে গেল টেরই পাইনি । হুঁশ ফিরলো ক্যান্টিনের জগাদার ফোনে। রাতের খাবার তৈরি।আমাদের খাওয়া হলে ওরা ক্যান্টিন বন্ধ করে বাড়ি যাবে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি কেউ খেতে রাজি না হওয়ায়, দায়িত্ব নিল অর্নব আর সৌমেন্দু ।খাবার এলো ঘরে।যদিও এটা নিয়মবহির্ভূত, হয়তো জগাদা রাজি হয়েছিল বাচ্চাগুলোর কথা ভেবে। কারণ আমাদের কটেজ থেকে ক্যান্টিন প্রায় হাফ কিলোমিটার রাস্তা। খাবারের ঢাকা খুলে আবার অবাক হওয়ার পালা। ফ্রায়েড রাইস আর চিলি চিকেন, যার গন্ধে ম ম করছে গোটা তল্লাটই।রাতের খাওয়া পর্ব মিটলে সুমিতদা বলল- চল, এবার হেঁটে আসি সমুদ্রের ধার থেকে। তখন রাত প্রায় ১২টা ।বাইরে বেড়িয়ে দেখি চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারদিক। আমরা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এসে পড়লাম সমুদ্র তটে। এখানে সমুদ্রের ধারে কোন আলো নেই আর সন্ধ্যের পর কোন কোস্টাল গার্ডও থাকে না। তালা পড়ে মেন গেটে।

পূর্ণিমা রাতে সাদা বালির সমুদ্র সৈকত সঙ্গে ভেজা ঠান্ডা হাওয়া। এক অব্যক্ত অনুভূতিতে ভেসে গেলাম সবাই। জীবনের এক রূপকথার রাত হয়ে তা রয়ে গেল সবার স্মৃতিতে।ভোরে ঘুম ভাঙল নাম জানা না-জানা পাখিদের ডাকে। শুনলাম শীতকালে এখানে আসে অনেক পরিযায়ী পাখি।সূর্যোদয় দেখে ফিরলাম। মনটা খারাপ হতে শুরু করলো। ফেরার সময় এগিয়ে আসছে। দুপুরের লাঞ্চ সেরে শরীরটা এলিয়ে দিলাম ট্যাভেলারের সীটে। পেছনে পড়ে রইলো হেনরি আইল্যান্ড আর মন কেমন করা পূর্ণিমা রাত। আস্তে আস্তে আমায় গ্রাস করছে শহুরে ব্যস্ততা আর মনে হচ্ছে ফের কাল ভোরে বেজে উঠবে মোবাইল এলার্ম।