হাত আর শ্বাসজনিত পরিচ্ছন্নতা সুনিশ্চিত করুন, ভারত সরকার দ্বারা জনস্বার্থে প্রচারিত।
জনস্বার্থ! আহা কী মহতী শব্দ!
শ্বাসের সুরক্ষা, শ্বাসের পরিচ্ছন্নতা! তা নিজের শ্বাস যখন, তখন নিজেকেই খোলা-বন্ধ করতে হবে। এই যা ভরসা। কিন্তু হাত! তাদের জিম্মা নাকি করোনাকালে নিয়ে রেখেছে সাবান আর স্যানিটাইজার। হেসে বাঁচি না! এ দেশে মানুষ যে আজও ‘হাত মাটি’ করে!
আজকাল গণ্ডেরীরামকে বড় মনে পড়ে। আহা, কী সাবলীল একটা মানুষ ছিলেন গো বাটপারিয়া দাদা! অনায়াসে সব বেচে দিয়ে যেমন টাকা রোজগার করতেন — তেমনই পুণ্য, সমানুপাতিক হারে। আহা গো, মানুষটা যদি আর ক’টা দিন বেঁচে থাকতেন!
আর এ পুণ্যবতী রামের দেশে একখানা পরশুরাম সেই যে জন্মেছিল, সে-ও আর ফিরল না! গণ্ডেরীকে দিয়ে তিনি আরও কত কী যে করিয়ে নিতে পারতেন! যদি আর ক’টা দিন বাঁচতেন! যদি করোনা-টা দেখে যেতে পারতেন! যদি ২০১৪, ২০১৯ সালটা দেখে যেতে পারতেন!…
হয়তো তাঁর মোবাইল ফোন থাকত একখানা। স্মার্টনেসে পরশুকে পাল্লা দিতে পারত না তবু সে ফোনে রোজই বেজে উঠত সাবধানবাণী— হাত আর শ্বাসজনিত পরিচ্ছন্নতা সুনিশ্চিত করুন, ভারত সরকার দ্বারা জনস্বার্থে প্রচারিত।
বাটপারিয়াদার বংশধরেরা এখন আরও উন্নত, আরও ভারী পদ মর্যাদা সম্পন্ন। মওকা বুঝে নিতে তাঁদের ইন্টেলিজেন্স ক্যোশেন্ট গণ্ডেরীর চেয়ে বেশ খানিকটা বেড়েছে শতাংশের হিসেবে। বিশ্ব অতিমারীর প্রেক্ষিতে তাঁরা মওকা বুঝে নিচ্ছেন কড়ায় গণ্ডায়। বেচতে বেচতে নিজের অন্তর্বাসখানিও না বেচে বসেন কোনদিন, সেই ভয়ে আছি!
আরো আছে কর। সে যে কী বিষম বস্তু! এই আছে, এই নেই, ঠিক যেন পাখি মেলে পাখনা…
তা এই হাতের পরিচ্ছন্নতার জন্য দিকে দিকে দামামা বেজেছে। ধাঁ করে কদর বেড়ে গিয়েছে সাবানের। সঙ্গে স্যানিটাইজার। বস্তুটা এতদিন এক কোণে পড়ে থাকত ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের তাকে। থরে থরে। কেতা দুরস্ত তরুণীর ঝকঝকে ব্যাগের কোনায় বাঁধা থাকত স্টেটাস সিম্বলের মতো। রেস্তোরাঁয় খেতে গেলে হাতে মেখে নিত মেয়ে। না, মুখের ওপর শুচিবামনি বলেনি তাকে কেউ বারবার হাত ধোয়া পিসির মতো। শুধু কেতার দিকে তাকিয়ে থেকেছে আম জনতা।
সেই স্যানিটাইজার হয়ে গেছে পকেটনিবাসী। স্যানিটাইজার এখন হাতে হাতে। দোকান-বাজার খুলছে জল মেশানো স্যানিটাইজারের ভরসায়। সরকারি আপিস, বেসরকারি হয়ে যাওয়ার আগে খানিকটা স্যানিটাইজার মেখে নিচ্ছে। আর যায় কোথায়! বাটাপারিয়ার ছানাপোনাদের চক্ষু চড়কগাছ। আমজনতার কাছে যেই না কদর বেড়েছে, অমনি তাকে নিয়ে টানাটানি। প্রথমেই তাই অ্যালকোহল যুক্ত স্যানিটাইজারকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য তালিকা থেকে বাদ দেওয়া গেল। ব্যাস। ফলে তার উপর চাপিয়ে দেওয়া গেল উচ্চ হারে জিএসটি— একেবারে ১৮ শতাংশ।
সেই স্যানিটাইজার হয়ে গেছে পকেটনিবাসী। স্যানিটাইজার এখন হাতে হাতে। দোকান-বাজার খুলছে জল মেশানো স্যানিটাইজারের ভরসায়। সরকারি আপিস, বেসরকারি হয়ে যাওয়ার আগে খানিকটা স্যানিটাইজার মেখে নিচ্ছে। আর যায় কোথায়! বাটাপারিয়ার ছানাপোনাদের চক্ষু চড়কগাছ। আমজনতার কাছে যেই না কদর বেড়েছে, অমনি তাকে নিয়ে টানাটানি।
এ হেন পরিস্থিতিতে জাত নিন্দুক বিরোধীরা বলেছিল, ঘটনাটা অন্যায় হচ্ছে। বিশ্ব অতিমারীর সময়ে অতিপ্রয়োজনীয় স্যানিটাইজারের উপর থেকে করের বোঝা হালকা করা হোক। হোক। হোক।
বসল আলোচনা সভা। দেদার কথাবার্তার শেষে ‘উপদেষ্টা মণ্ডলী’ বললেন, কর কমালে দেশ নিজের পায়ে দাঁড়াবে কী করে?
কী করে?
স্যানিটাইজারের উপর থেকে জিএসটি কমিয়ে দিলেই নাকি ভারতীয় বাজার ছেয়ে যাবে আমদানি করা স্যানিটাইজারে। কাঁচামালের উপর বেশি জিএসটি থাকায় ভারতীয় স্যানিটাইজার উৎপাদকেরা বাধ্য হবেন মূল্যবৃদ্ধি করতে। ফলে বাজারে মার খাবেন তাঁরা। তাতে আদতে কমে যাবে ভারতের বৃদ্ধি।
দাদা অঙ্ক বড় কঠিন। বুঝতে গেলে প্রথম জানতে হবে পাটিগণিত। তারপর অর্থনীতি। তারপর রাজস্বনীতি। তারপর বিদেশনীতি। তারপর বৈদেশিক বাণিজ্যনীতি… ও বাবা!
আসুন তার চেয়ে বরং দেখে নিই, এই করোনাকালে এ ভারতবর্ষে আর কী কী জিনিসের উপর জিএসটি আছে। এই যেমন সাবান, ডিজইনফেকট্যান্টের উপর ১৮ শতাংশ, গ্লাভস, পিপিই কিট, ফেস শিল্ড ১৮ শতাংশ, সাধারণ সুতির মাস্কের উপর ৫ শতাংশ, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন দূষণ প্রতিরোধী মাস্কে ১২ শতাংশ, চক্ষু সুরক্ষার জন্য ব্যবহৃত চশমায় ১২ শতাংশ, ভেন্টিলেটরে ১২ শতাংশ, শরীরের তাপমান মাপক বিশেষ যন্ত্রাদির উপর ১৮ শতাংশ, ওষুধপত্র ও রোগ নির্ণায়ক সরঞ্জামের উপর ৫ শতাংশ, টিস্যু ন্যাপকিনে ১৮ শতাংশ, হাসপাতালে রাখা বিশেষ বর্জ্য নিষ্কাশন পাত্রের উপর ১৮ শতাংশ জিএসটি রয়েছে৷
আর যে সব বিমা সংস্থা তাদের প্যাকেজে নতুন করে কোভিদ-১৯ কে যুক্ত করেছে, তাদেরও ওই ১৮ শতাংশ হারেই জিএসটি নেওয়ার কথা বলা হয়েছে প্রিমিয়ামের উপর।
১৩ লক্ষ আক্রান্তের দেশে মানুষের ঠাঁই নেই সরকারি হাসপাতালে। এই তো শুনলাম, কোন এক বেসরকারি হাসপাতাল নাকি বলেই রেখেছে দিনে সাতটা পিপিই-র দাম মেটাতে হবে রোগীর পরিবারকে। এক একটার দাম ১১০০ টাকার বেশি। তা ছাড়া ওষুধপত্র, চিকিৎসা পরিষেবা তো রয়েছেই।
তবে আপনার যদি জিএসটি দিতে এতই গায়ে লাগে তবে সোনা হীরের গয়না কিনে রাখতে পারেন। সোনার গয়নায় মাত্র ৩ শতাংশ আর হীরের গয়নায় ০.২৫ শতাংশ জিএসটি। বড় বড় সোনার দোকানগুলো রোজ বার্তা পাঠাচ্ছে, আসুন, গাড়ি রাখুন, গয়না কিনুন। এমনকি এই তো সে দিন বার্তা পেলাম দোকানের গাড়ি নাকি তুলে নিয়ে যাবে আমাকে গয়না কেনার জন্য।
এ সব দেখে আপনি যদি খুব অবাক হয়ে গিয়ে থাকেন, তবে পরামর্শ রইল অবাক হবেন না। ২০১৮ সালের কথা মনে আছে?
সে বছর ফেব্রুয়ারি মাসে রিলিজ করেছিল একটা বলিউডি সিনেমা। নাম ভূমিকায় অক্ষয় কুমার। পাহাড় প্রমাণ ট্যাবু ভেঙে তিনি মেয়েদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন প্যাড, ওরফে স্যানিটারি ন্যাপকিন। উফ! কী হিট কী হিট সে সিনেমা।
তারপরই জুলাই মাসে পরম দয়ালু রাষ্ট্র স্যানিটারি ন্যাপকিনের উপর থেকে জিএসটি তুলে নিল সম্পূর্ণ। আহা কী মহতী সিদ্ধান্ত! কিন্তু এমন একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য দেশ-মাথাদের অপেক্ষা করতে হল, কবে একটা সিনেমা তৈরি হয়! আর চেনা নায়ক বাণী ছড়ান! অথচ, অরুণাচলম মুরুগুনাথম এ সব কথা বলছেন অনেক দিন ধরেই।
আরে ভাই, একটা ঝ্যাকান্যাকা চাই তো! গণ্ডেরী বলেছেন, “ভেস বিনা ভিখ মিলে না” … নিয্যস সত্য৷ আর সিনেমার থেকে বেশি, বলিউডি সিনেমার থেকে বেশি ঝ্যাকান্যাকা আর কোথাও নেই, জানে সারা জামানা!
অপেক্ষায় আছি, একটা অক্ষয়সিনেমা আসুক— স্যানিটাইজার ম্যান…