না-বলা কথা

দলের মধ্যে একা

By admin

September 07, 2020

দেবাশিস ঘোষ, অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস

তারিখটা মনে নেই , সাল অনুমান করি ১৯৮৭ ই হবে । বিরাট জমায়েত পুরুলিয়া শহরের মানভূম নিখুঁত সুন্দরী স্টেডিয়ামে । সমাবেশ ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার। কোথা থেকে না কোথা থেকে লোক এসেছে ,তার ইয়ত্তা নেই । সকলে তারা পুরুলিয়া জেলার নয় , এমনকি এই রাজ্যেরও নয় । সভার শুরু সন্ধ্যার শুরুতে , শেষ হতে হতে রাত প্রায় শেষ । বাকি রাতটুকু ওই খানেই যেখানে খুশি গড়িয়ে পড়ে কাটিয়ে দেওয়া ।মিটিংয়ের আগে মিছিল,তখন যা সব ঘটে গেছে , তা আর কহতব্য নয় । নিয়ন্ত্রণ অসাধ্য সে মিছিল সর্বার্থেই অচল করে দিয়েছিল শহর । মিটিং যখন শেষ হলো , রাত তখন অনেক । মিটিং শেষ বটে , কিন্তু কর্মকান্ড তখনও শেষ হয়নি । স্টেডিয়ামের অফিস রুমে আমাদের শরীর তখন ক্লান্তিতে এলিয়ে পড়েছে চেয়ারের উপর । ঠিক সেইসময় , কয়েকটা ছেলে এসে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল ঘরের মধ্যে । চোখেমুখে তাদের উদ্বেগ আর আশঙ্কা । যা বলল তা সংক্ষেপে এইরকম যে তারা বাইরে থেকে এসেছে ট্রেনপথে । সকলেই এক ট্রেনে নয় , কেউ আগে কেউ পরে । আগের ট্রেনে যারা এসেছে তাদের কারো একজনের বোন পরের ট্রেনে এসেছে অন্য আরো কয়েকজনের সাথে । অনেকেই মেয়েটিকে দেখেছে একই ট্রেনে তাদের সাথে আসতে কিন্তু পুরুলিয়া স্টেশনে নেমে হেঁটে আসবার পথে তাকে আর দেখা যায়নি । স্রোত বয়ে গেল শিরদাঁড়ায় , শুরু করে দিতে হলো ছোটাছুটি তথা অনুসন্ধান পর্ব ।

সমষ্টি কখনো ব্যক্তির নিঃস্বতা দূর করতে পারে না স্যার । সমষ্টি কেবল সামান্য অংশই ছুঁয়ে থাকে ব্যক্তির , কেবল ঐটুকুই পারে ।

মেয়েটাকে উদ্ধার করা হলো একটা সস্তার হোটেল থেকে । সঙ্গে যাকে পাওয়া গিয়েছিল সেও ঐ দলের সমর্থক, একই ট্রেনে উঠেছিল ঘোষিত ভাবে মিছিলে এবং মিটিংয়ে যোগ দিতেই । অভিপ্রায়ে মিল হয়ে গিয়েছিল বলে দ্রুত সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে তাদের দুজনের বাঁধেনি । প্রথমে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়িয়েছিল , হোটেলে ওঠার সাহস তখনও সঞ্চয় করে উঠতে পারেনি । কিছুটা ভীতি দূর হওয়ার পর হোটেল মুখো যখন হলো , তখন কয়েকবার প্রত্যাখাত হওয়ার পর জায়গা পেয়েছিল ওই বিশেষ হোটেলে । ইতোমধ্যে সময় বয়ে গিয়েছিল অনেক , তাই চূড়ান্ত বরবাদির আগেই উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল। দাদা চেয়েছিল কেস হোক , শাস্তি হোক ছেলেটার , কিন্তু দল চায়নি । দল দাদাকে নিরস্ত করেছিল। বাধা দিয়েছিল যাতে সে আর অগ্রসর হতে না পারে , কারণ কেস হলে তা হবে একজন ঝাড়খণ্ডির বিরুদ্ধেই ।খানিক পরে সেই দাদা আবার এলো সেই ঘরে । এসেই জোর করে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে নিজের ভাষায় বহুবিধ কৃতজ্ঞতা জানাতে থাকল , বোনটি তার চূড়ান্ত বরবাদি থেকে রক্ষা পেয়েছে বলে । জিজ্ঞেস করলাম ,”এত বড় জমায়েত , এত লোক তোমাদের , তোমরা চাইলে তো ওই এলাকা তোলপাড় করে দিয়ে উদ্ধার করে নিয়ে আসতে পারতে তোমার বোনকে ! আমাদের কাছে এসেছিলে কেন ?”। ছেলেটা মুখের দিকে চেয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর নিজের ভাষায় , নিজের ব্যাখ্যায় উত্তর দিয়েছিল।উত্তরের ভাষা মনে নেই। ব্যাখ্যাও না । কিন্তু সার কথাটা মনে আছে । বলেছিল, সমষ্টি কখনো ব্যক্তির নিঃস্বতা দূর করতে পারে না স্যার । সমষ্টি কেবল সামান্য অংশই ছুঁয়ে থাকে ব্যক্তির , কেবল ঐটুকুই পারে । ব্যক্তিকে বলি দিলে যদি সমষ্টির বা দলের পথ সুগম হয় তাহলে ব্যক্তিকে বলি দিতে তাদের দ্বিধা নেই । তারপর যখন খেয়াল করল যে তার সব কথাই দলের বিপক্ষে যাচ্ছে তখন বলল , পালোয়ান কি মাটি থেকে সূঁচ কুড়োতে পারে ? পারে না , তার হাতের পাকাড়ের মধ্যে আসে না। তাই ফেলে রেখে যায় , তখন আপনাদের কাছে সাহায্য চাইতে হয় ।