%%sitename%%

না-বলা কথা

উচ্ছেদ

By admin

August 22, 2020

সরকারি চাকরির সূত্রে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় কাজ করতে গিয়ে মানুষের দারিদ্র্যের ও অসহায়তার যে ভয়াবহ রূপ দেখেছি তার সঙ্গে জীবনের অন্য কোনও অভিজ্ঞতার তুলনা হয় না। পাশাপাশি এটাও মনে হয় আমাকে ভাববিলাসের জগত থেকে বাস্তবের জমিতে নামিয়ে আনতে সরকারি চাকরির অভিজ্ঞতার দরকার ছিল। চাকরি করতে গিয়ে মাঝে মাঝে এমন কিছু কাজ করতে হয়েছে যা আইনের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত, অথচ তার জন্য পরে নিজেকে অপরাধী মনে হয়েছে। তেমনই একটি কাহিনি এখন বলব। বিশেষ কারণবশত এই কাহিনিতে স্হান, নাম ও ব্যক্তি নাম উহ্য রাখা হল।

এটা ২০০৬ সালের কথা। আমি তখন উত্তরবঙ্গের একটি জেলার কোনও একটি ব্লকে সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিক হিসাবে কর্মরত। এক দিন একটি লোক আমার সঙ্গে দেখা করতে এল। হাড় জিরজিরে চেহারা, শতচ্ছিন্ন পোশাক, কোটরে ঢোকা চোখ, মুখে দারিদ্র্য কশাঘাতের স্হায়ী চিহ্ন এঁকে দিয়েছে। সে যে নিদারুণ দারিদ্র্যের শিকার তা আর বলে দিতে হয় না। আমি তখন কোনও একটা জরুরি ব্যাপার নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। তাই লোকটির দিকে তাকিয়ে বললাম যা বলার তাড়াতাড়ি বলতে।

লোকটি জানাল সে একজন ভূমিহীন মানুষ। একটুকরো জমির জন্য সে মুলুক ছেড়ে এখানে এসে নদীর ধারে কুঁড়েঘর তৈরি করে মাথা গুঁজেছিল। কিন্তু নদীর ভাঙনে তার সেই ঘরে নদীগর্ভে চলে যায়। ফলে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে তাকে গাছতলায় দাঁড়াতে হয়। তার পর সে বেশ কয়েকবার সরকারের কাছে জমির জন্য আবেদন করেছিল। কিন্তু তার আবেদনে কোনও ফল হয়নি। অবশেষে প্রাণের তাগিদে সে সরকারি জমি দখল করে সেখানে ঘর বেঁধেছে। কিন্ত দিন কয়েক আগে জমি দপ্তরের লোকেরা তাকে নোটিশ দিয়েছে সরকারি জায়গা ছেড়ে উঠে যেতে হবে। তাই সে আমার কাছে এসেছে, যাতে আমি তার জন্য কিছু একটা করি।

লোকটিকে আমি তখনই কিছু বলতে পারলাম না। কিন্তু তার অসহায়তা অন্তর থেকে উপলব্ধি করতে পারছিলাম। একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসাবে তার কিছু মৌলিক অধিকার আছে। পাশাপাশি এটাও তো সত্যি যে সরকারি জমিতে সে একজন বেআইনি দখলদার ছাড়া আর কিছু নয়। এবং সরকারি জমি দখলমুক্ত করাটাও দরকার। আর একজন স্হানীয় ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে সে কাজে সাহায্য করাটা আমার কর্তব্য। যাই হোক তখনকার মতো লোকটিকে বললাম তার ব্যাপারে পঞ্চায়েত সমিতির সঙ্গে কথা বলব, যাতে ভবিষ্যতে তার সমস্যার কিছু সুরাহা করা যায়।

আমাকে হাতজোড় করে নমস্কার জানিয়ে লোকটি চলে গেল। তবে আমার কথায় সে যে কতটা আশ্বস্ত হল বলা শক্ত। পরদিনই আমি পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতির সঙ্গে লোকটিকে নিয়ে কথা বললাম, যাতে গৃহহীন দের জন্য কোনও একটি সরকারি আবাসন প্রকল্পের আওতায় তাকে ঘরে তৈরি করে দেওয়া যায়। কিন্ত কথা বলতে গিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের স্বার্থপরতার রূপটিই প্রত্যক্ষ করলাম। সভাপতি বললেন আগে দেখতে হবে লোকটির রাজনৈতিক আনুগত্য কোন দিকে। তার পর এ বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করা যাবে। মোটমাট এটা বুঝলাম যে তিনি বিশেষ কোনও সাহায্য করবেন না। কিন্তু আমি হাল ছাড়লাম না। বেশ জোর দিয়ে বললাম ঘর যদি না-ও বা দেওয়া যায়, তাহলে পরবর্তী সরকারি জমির পাট্টা প্রাপকদের তালিকায় যেন এই লোকটির নাম থাকে। এই প্রস্তাবে সভাপতি নিমরাজি হলেন। তাঁর কাছ থেকে উঠে আসার পর মনে মনে স্থির করলাম যখনই সুযোগ আসবে, তখনই লোকটির জন্য কিছু একটা করব।

এ দিকে পরের সপ্তাহে বেআইনিভাবে দখল করা সরকারি জমি দখলমুক্ত অভিযান চালানো হল। জমি দপ্তরের লোকজন গেল, সেপাই-সান্ত্রী গেল, বুলডোজার গেল। আর এ কাজ করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা যাতে বিঘ্নিত না হয়, যাতে সুষ্ঠুভাবে সব কিছু সম্পন্ন হয় তা দেখার জন্য আমি গেলাম। মহা আড়ম্বরে হতদরিদ্র মানুষটির কোনওমতে খাড়া করা ঘরটা ভেঙে দেওয়া হল। বৌ-ছেলেমেয়ে নিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে শূন্যদৃষ্টিতে চেয়ে রইল লোকটি। তার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল।

পরের দিন অফিসে এসে প্রথমেই লোকটির খোঁজ করলাম। জানা গেল উচ্ছেদ করার রাতেই সে স্ত্রী-সন্তানদের হাত ধরে গ্রাম থেকে চলে গেছে। অনেক খুঁজেও আমি তার কোনও সন্ধান পাইনি। শুধু তার চোখের সেই শূন্য দৃষ্টি দীর্ঘকাল যাবৎ আমায় তাড়া করে বেরিয়েছে।