ঘুরে-ট্যুরে

ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া

By admin

October 31, 2020

উজ্জ্বল বিশ্বাস। ছবি: প্রতিবেদক

সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার,কাল রাতেও বেশ এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। আজ ষষ্ঠী, মন্ডপে মন্ডপে দেবীর বোধন শুরু হয়েছে। এই অতিমারির সময়ও পরিচিত চারপাশটা একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে। ঘরে বন্দি থাকতে থাকতে সবাই মানসিক ভাবে ক্লান্ত। তাই বুকে অনেক বল সঞ্চয় করে কয়েকজনে মিলে বেড়িয়ে পড়েছি, কলকাতার খুব কাছেই মাত্র ৫১ কিলোমিটার দূরে ফলতার উদ্দেশ্যে। এর জন্য অবশ্যই মহুয়ার কৃতিত্ব অনেক,বেচারি একাই অনেক লড়াই করে রিসর্টে পাশাপাশি এতগুলো রুম বুক করেছে।ডায়মন্ডহারবার রোড ধরে চলা শুরু করলাম,আমাদের অনেক বড় গ্রুপ, তাই গাড়িও অনেক, আমতলা ছাড়ানোর পর মনটা চা চা করাতে রাস্তার বাঁ ধারে এক ধাবায় চা পানের বিরতি নেওয়া হল। গাড়ি থেকে নেমে, হন হন করে হেঁটে বসার জায়গায় সবার আগে পৌঁছলো সঞ্চিতা,হাতে ইয়া বড় এক সেনিটাইজার স্প্রে। নিমেষে ধাবার শুধু বসার জায়গা কেন,সমস্ত পরিবেশ করোনা মুক্ত হল,যদিও আমাদের সাথে চারটে বাচ্চা,তাই ব্যাপারটা মজার হলেও যুক্তিযুক্ত। সাকুল্যে ঘন্টা দুয়েকে পৌঁছে গেলাম ফলতার “রাজহংস হোটেল এন্ড রিসর্ট ” এ। একদম গঙ্গার পাড়েই এমন মনোরম এবং স্বাচ্ছন্দ যুক্ত থাকার জায়গা আমাদের বেড়ানোটাকে আরও মূল্যবান করে তুললো। ঘরের জানলা খুললেই দুচোখে প্রশান্তি নিয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গা নদী। এখানে আকারে বেশ প্রশস্ত। জানালা দিয়ে তেড়ে আসছে অবিরাম এক শরীর আবেশ করা হাওয়া, তার দাপট এলোমেলো করে দিচ্ছে সবকিছু। গঙ্গার পাড় বরাবর কৃষ্ণচূড়া গাছের সারি,সঙ্গে দল বেঁধেছে বট,অশোক। বাঁ হাতে গঙ্গাকে রেখে পাড় ধরে হেঁটে যাওয়া যায় অনেকদূর,সেই পুরনো জেটিঘাট অব্দি। গঙ্গার পাড় ধরে এই রাস্তাটা অসাধারণ, নিরিবিলি, আপন ভোলা । পাড়ে এসে আছড়ে পড়ছে ছোট ছোট জলের কুন্ডুলি, তার অবিরাম শব্দের মূর্ছনা নেশা ধরিয়ে দেয়। গায়ে এসে মাখামাখি করে একটু নোনা হাওয়া, যেন সমুদ্রের গা ঘেঁষে ঘেঁষে একসাথে এসেছে এতদূর ।

দূরে গঙ্গায় নানা আকারের মাছ ধরার ডিঙি নৌকা দেখে মনে হয় এক্কা দোককা খেলছে জলের সাথে। থেকে থেকে বিষন্ন “ভোঁ” দিয়ে জলের বুক তোলপাড় করে এক বন্দর থেকে আর এক বন্দরে চলেছে বিশাল সব মালবাহী জাহাজ। এই সব দেখতে দেখতে মেঘের বুক চিরে এক ফালি তেরছা সূর্যের আলো বুঝিয়ে দিল,আজ যাবার সময় হয়েছে। গঙ্গার ওপারে দিক বিদিক সোনালি আলোয় মাতোয়ারা করে ঝুপ করে সন্ধ্যে নেমে এলো।সুইমিং পুলের ধারে সন্ধ্যের পানাহারের ব্যবস্থা নিয়ে দুপুর থেকেই ব্যস্ত ছিল অর্নব আর সৌমেন্দু। সন্ধ্যার কয়েক ঘণ্টা সুইমিং পুলের জলে ধাক্কা খাওয়া মায়াবী নিওনের আলোয়, অনুপমদার খাতা দেখে গান গাওয়াতেও, অদম্য এক সদ্য প্রেমে পড়া কিশোরীর মত ,না ভুলতে চাওয়া একটা সন্ধ্যা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকলো।ঘুমোতে যাওয়ার আগে জানিয়ে রাখি -শান্ত মনোরম প্রকৃতিক পরিবেশ শুধু নয় ফলতার ইতিহাসও খুব বর্ণময়। ১৭৫৬ সালে নবাব সিরাজদৌললা যখন কলকাতা দখল করেন তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীরা লুকিয়ে ফলতায় এসে গা ঢাকা দেন। শুধু তাই নয় ওলন্দাজ নাবিকেরা এই ফলতাতেই তাদের বানিজ্যের ঘাঁটি গেড়েছিল। ফলতার দক্ষিণে ১০ কিলোমিটার দূরে নদীর ওপার গড়চুমুকে কাছে দামোদর আর হুগলি নদীর সঙ্গম স্থল। আবার ১৬ কিলোমিটার দূরে নূরপুরের অপর দিকে গাদিয়াড়া, যেখানে এক সাথে মিশেছে হুগলি,দামোদর আর রূপনারায়ণ নদী। পৃথিবী বিখ্যাত বিজ্ঞানী, আমাদের বাঙালির গর্ব জগদীশচন্দ্র বসুর বাগান বাড়ি রয়েছে এই ফলতায়। বানিজ্য নগরী হিসেবে যথেষ্টই পরিচিত এই ফলতা এবং কেন্দ্রীয় সরকার একে “স্পেশাল ইকোনমিক জোন” হিসাবে ঘোষণা করছে।

কথা মত ভোর পাঁচটার ঘুম থেকে উঠলাম,যদিও আকাশ বেশ অভিমানী, মুখ কালো করে আছে। হোটেলের গেট থেকে ডান দিকে দু পা এগোলেই সনাতনদার চায়ের দোকান, কিন্তু প্রয়োজনীয় সব জিনিসই পাওয়া যায়। উল্টো দিকেই বিরাট এক ঝামড়ে পড়া বট গাছের নিচে মা কালীর থান, চোখে চোখ রাখা দায়, নিত্য পূজোর আয়োজন আছে। সনাতনদা চা বসিয়েছে, আমাদের অগোচরে দুটো সন্ডা মার্কা কুকুরকে নিজের হাতে বিস্কুট খাইয়েছে অর্নব। কিন্তু তারা যে মধুমিতার এত ভক্ত হয়ে উঠবে কে জানে ! মধুমিতা স্কার্ট তুলে দৌড়াচ্ছে,আর তারা পেছন পেছন। হঠাৎ টিপ টিপ করে বৃষ্টি এলো , চায়ের দোকানে জড়সড় হয়ে দাড়িয়ে সবাই। চা খাওয়া তখনো শেষ হয়নি, দূর থেকে ভেসে আসছে ঢাকের আওয়াজ, মানুষের উচ্ছাসের কল কাকলি। আমরা সবাই এগিয়ে গেলাম নদীর ধার ধরে ধরে, গ্রামের পূজোর “নব পত্রিকা ” স্নান করাতে এসেছে অনেক মানুষ। সেই সকালেই উঠতি যুবতী থেকে শুরু করে সদ্য বিবাহিত মেয়েদের লাজুক দৃষ্টি নিজেকে শহুরে বলে ঘাটের মড়া ভাবতে একবিন্দু দিধা করি নি। ভেবেছি অতিমারি মানুষের শারীরিক ব্যবধান ঘটালেও মনের কোন দুরত্ব তৈরি করতে পারে নি আজও।

হোটেলের মেন গেটের ঠিক বাইরে,একটু ডান পাশে,নদীর তৈরি ছোট্ট খাড়ির মত জায়গায় সার সার ট্রলারের থাকার জায়গা। ভোর হতেই শুরু হয় ব্যস্ততা। জাল শুকানো, পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখা, তার গাটড়ির হিসেব ইত্যাদি নানাবিধ কর্ম কান্ড চলতে থাকে। পরিচয় হল দিলীপ বাউরির সাথে।তিন পুরুষের জেলে, মাসে দুবার করে মাঝ সাগরে যায় মাছ ধরতে। এ বছরটা সব দিক থেকেই খুব খারাপ। লকডাউন, আমফান থেকে শুরু করে নানা সরকারি বাধা নিষেধের জেরে, সব মৎসজীবীই খুব খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে চলছে। কথা বলতে বলতেই হঠাৎ দেখি মানুষজনের দৌড়া-দৌড়ি, হুড়োহুড়ি, চিৎকার চেঁচামেচি ,হতভম্ব হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম একটা ট্রলার ঘাটে ভিড়ছে,তাই মানুষের এত উন্মাদনা। নিমেষে শান্ত পরিবেশ, জন বহুল বাজারের চেহারা নিল।মাছ নামতে শুরু করলো, সমুদ্রের রুপালি ফসল,তাকে ঘিরে হাকাহাকি, দরাদরি,ফড়েদের জটলা, আঁশটে গন্ধে ভারি হয়ে গেল চারপাশের বাতাস, চা শেষ করে উঠে পড়লাম। হোটেলে ফিরে দেখি সমস্ত কচিকাঁচা সুইমিং পুলের জলে জলকেলিতে মত্ত। আস্তে আস্তে এক এক করে বড়রাও হাজির,তবে বেশ ভালই লাগছিল এটা দেখে যে মানুষের চেনা ছন্দ ,আমাদের কত প্রিয়।

একটা কথা বলতে ভুলে গেছি,যার কথা না বললে ফলতা বেড়ানোর গল্প অসম্পূর্ণ থেকে যায়। হোটেলের ঠিক উল্টো দিকে গঙ্গার পাড় বরাবর তৈরি হয়েছে এক মনোরম বাগান,শীতকালে ওখানে ভিড় জমায় কাছে দূরের পিকনিক পার্টি। অজস্র ফুলের গাছ,কেয়ারি করা বাগান,নানা রকম জয় রাইড,দোলনা, সব মিলিয়ে বাগানটা একদম নন্দন কানন। গঙ্গার ধারে বসার জায়গা, বাঁশের মাচা, অলস সময়কে পলে অনু পলে উপলব্ধি করার এমন নিঃশব্দ পরিবেশ,আমদের মত শহুরে মানুষের কাছে বিশাল পাওনা।দুপুরে ভেটকি আর পমেফ্রট মাছ দিয়ে রাজকীয় খাওয়া দাওয়া করে, বিকেলে নদীর ওপারে সূর্যের ঢলে পড়াকে সাক্ষী রেখে,ফিরে চললাম সেই পরিচিত শহরের দিকে। সপ্তমীর সন্ধ্যা, আলো ঝলমল চারপাশ, মাইকে পরিচিত বাংলা গানের ফাঁকে ফাঁকে শুধু নেই সেই পরিচিত ঘোষণা- “মন্ডপে অযথা ভিড় করবেন না, সামনের দিকে এগোতে থাকুন…পরবর্তী দর্শনার্থীদের প্রতিমা দেখার সুযোগ করে দিন”…….