এক নজরে

শীতের ছোঁয়া লাগা গদ্য পদ্য

By admin

January 08, 2023

দ্বিতীয় পর্ব

কালিদাস শীত নিয়ে ‘ঋতুসংহার’ কাব্যে লিখেছেন, “হে সুন্দরী! এ বার শীতঋতুর কথা শ্রবণ করো/এই ঋতু শালিধান ও আমের প্রাচুর্যে মনোহর।” মধ্যযুগের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্র্তী লিখেছিলেন, “উদর পুরিয়া অন্ন দৈবে দিলা যদি।/যম-যম শীত তিথি নিরমিলা বিধি/…পৌষের প্রবল শীত সুখী যে জন।/তুলি পাড়ি আছারি শীতের নিবারণ।।/ফুলরা কত আছে কর্মের বিপাক/মাঘ মাসে কাননে তুলি নাহি শাক॥” আধুনিক কালের ঈশ্বর গুপ্তর কবিতায়ও শীতের বর্ণনা আছে ‘কাব্য কানন’ গ্রন্থের ‘মানিনী নায়িকার মানভঙ’ কবিতায় খানিকটা কৌতুক ও হাস্যরসে, “বসনে ঢাকিয়া দেহ গুঁড়ি মেরে আছি।/উহু উহু প্রাণ যায় শীত গেলে বাঁচি॥/হাসিয়া নাগর কহে, খোল প্রাণ মুখ।/শীত-ভীত হয়ে এত ভাব কেন দুখ॥/ছয় ঋতুর মধ্যে শীত করে তব হিত।/হিতকর দোষী হয় একি বিপরীত॥”

জসীমউদ্দীনের কবিতায় পাই শীতকালের প্রবল ও আন্তরিক বর্ণনা – “ঘুম হতে আজ জেগেই দেখি শিশির-ঝরা ঘাসে,/সারা রাতের স্বপন আমার মিঠেল রোদে হাসে।/আমার সাথে করত খেলা প্রভাত হাওয়া, ভাই,/সরষে ফুলের পাপড়ি নাড়ি ডাকছে মোরে তাই।/চলতে পথে মটরশুঁটি জড়িয়ে দুখান পা,/বলছে ডেকে, ‘গায়ের রাখাল একটু খেলে যা!’”…( ‘রাখাল ছেলে’)।

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় ঘুরে ঘুরে আসে ‘পউষের ভেজা ভোর’, ‘নোনাফল’, ‘আতাবন’ ‘চুলের উপর তার কুয়াশা রেখেছে হাত’, ‘ঝরিছে শিশির’, ‘পউষের শেষরাতে নিমপেঁচাটি’।‘শীতরাত’ কবিতায় কবি লেখেন, “এইসব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে;/বাইরে হয়ত শিশির ঝরছে, কিংবা পাতা।” ফেরলেখেন– “জানালার ফাঁক দিয়ে ভোরের সোনালি রোদ এসে/আমারে ঘুমাতে দেখে বিছানায়,— আমার কাতর চোখ, আমার বিমর্ষ ম্লান চুল—/এই নিয়ে খেলা করে: জানে সে যে বহুদিন আগে আমি করেছি কী ভুল/পৃবিবীর সবচেয়ে ক্ষমাহীন গাঢ় এক রূপসীর মুখ ভালোবেসে।” কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘দোলনচাঁপা’ কাব্যে ‘পৌষ’ কবিতায় লিখেছেন, “পউষ এলো গো।/পউষ এলো অশ্রু পাথার হিম পারাবার পারায়ে।”

যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত শীতকালকে দেখেছেন সম্পূর্ণ অন্য ভাবে। তাই তাঁর ভাষাও ভিন্ন – “মরণের আবাহন তরে কেন এই তীব্র আরাধন – চেষ্টা/সর্বনাশী/বর্ষপরে বিশ্বজুড়ে বসিলে আবার, হে রুদ্র সন্ন্যাসী।/তোমার বিশাল বক্ষে উঠিছে পড়িছে/পূরকে রেচকে দীর্ঘশ্বাসে/ওগো যোগীশ্বর!/তব প্রতি পূরক নিঃশ্বাস আকষিছে দুর্নিবার টানে/মৃত্যুভয়ভীতি সর্বজনে তব বক্ষ গহ্বর পানে।/…শীত ভয়ংকর!” সুকান্ত ভট্টাচার্যের কাছে শীতের দিনের সূর্য এক টুকরো সোনার চেয়েও দামী মনে হয় – “হে সূর্য!/তুমি আমাদের স্যাঁতসেঁতে ভিজে ঘরে/উত্তাপ আর আলো দিও/আর উত্তাপ দিও/রাস্তার ধারের ওই উলঙ্গ ছেলেটাকে।”

নবারুণ ভট্টাচার্যও শীতকে দেখেছেন পীড়িতের, বঞ্চিতদের চোখ দিয়ে। পাশাপাশি তাঁর কবিতায় উচ্চকিত হয়েছে মানবতা। “এনজিওরা কি জানে যে আমার/আর দরকার নেই সহৃদয় কম্বল/বা সাহেবদের বাতিল জামার/সবারই কি শীত করছে এমন/না শুধুই আমার/গাছেদের কি শীত করছে এমন/কুকুরদেরও কি শীত করছে এমন”।

শীতের বিশেষ অনুষঙ্গ কুয়াশা। সেই কুয়াশা কবির কাছে সংশয়চেতনা প্রকাশের অব্যর্থ উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় পাওয়া যায় এমন ভাবনার প্রকাশ – “ঘোচে না সংশয়/তোমারে নেহারি কি না প্রসারিত মাঠে/প্রত্যুষের কুয়াশায় ঢাকা খেয়াঘাটে/গৃহগামী কৃষকেরা যাবে সন্ধ্যাবেলা/জটলা পাকায়” (‘অনিকেত’)। কবি কখনও শীতের রিক্ততাও প্রত্যাশা করেন – “আমি যদি মরে যেতে পারতুম/এই শীতে,/গাছ যেমন মরে যায়,/সাপ যেমন মরে থাকে/সমস্ত দীর্ঘ শীত ভ’রে।” বুদ্ধদেব বসুমনে করেন, শীত মানুষের চেতনায় যে অনন্বয় ও নির্বেদ সৃষ্টি করে, পরিণতিতে যা জন্ম দেয় মহার্ঘ্য নিঃসঙ্গতা– তাই কবির কাছে সৃষ্টিশীলতার আদি উৎস। “এসো, শান্ত হও; এই হিম রাতে, যখন বাইরে-ভিতরে/কোথাও আলো নেই,/তোমার শূন্যতার অজ্ঞাত গহবর থেকে নবজন্মের জন্য/প্রার্থনা করো, প্রতীক্ষা করো, প্রস্তুত হও”। (‘শীতরাত্রির প্রার্থনা’)। শামসুর রহমান ‘রূপালি স্নান’ কবিতায় লেখেন, “দু’টুকরো রুটি/না-পাওয়ার ভয়ে শীতের রাতেও এক-গা ঘুমেই বিবর্ণ হই,/কোনো একদিন গাঢ় উলাসে ছিঁড়ে খাবে টুঁটি/হয়ত হিংস্র নেকড়ের পাল, তবু তুলে দিয়ে দরজায় খিল।” আল মাহমুদ লেখেন,  “কখনো ভোরের রোদে শিশিরের রেনু মেখে পায়/সে পুরুষ হেঁটে যায় কুয়াশায় দেহ যায় ঢেকে।” শীত আর শীতের অনুষঙ্গ কিংবা শীতের পাখি কবির চেতনায় জন্ম দেয় অন্য ভাবনা। আকাঙ্খার নারীকে কবি শীত-অনুষঙ্গ দিয়ে আলিঙ্গন করেন এই ভাবে- “শীতের সমূহ পাখি ক্ষিপ্ত লাফ/দিয়েছে তোমারই অমল যোনির পানে।/একটি স্বর্ণপাত পুড়ে উত্তরোত্তর ঘন-ধোঁয়া/নামহীন নিঃস্ব স্বর্গচূড়ে যায়/নীলিম বরফে বন্ধ অনাদিকালের সাইবেরিয়া-/পায়ের উপর থেকে ক্রমে শাল উড্ডীন মরালসম।/তোমার উজ্জ্বল ঊরু দেখে মনে হয় মরে যাবো।”(শক্তি চট্টোপাধ্যায়/‘বৃক্ষের প্রতিটি গ্রন্থে’)

পদ্যের মতো গদ্যেও শীত বিষয়ক অসংখ্য বর্ণনা আছে। সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর ‘চাঁদের অমাবস্যা’ উপন্যাসে শীতের বর্ণনা বেশ আকর্ষণীয়। “শীতের উজ্জ্বল জ্যোৎস্নারাত, তখনো কুয়াশা নামে নাই। বাঁশঝাড়ে তাই অন্ধকারটা তেমন জমজমাট নয়। সেখানে আলো-অন্ধকারের মধ্যে যুবক শিক্ষক একটি যুবতী নারীর অর্ধ-উলঙ্গ মৃতদেহ দেখতে পায়।” ‘লালসালু’তেও ধান সিদ্ধ করার বর্ণনা দিয়েছেন, “পৌষের রাত। প্রান্তর থেকে ঠা-ঠা হাওয়া এসে হাড় কাঁপায়। গভীর রাতে রহিমা আর হাসুনির মা ধান সিদ্ধ করে। খড়কুটো দিয়ে আগুন জ্বালিয়েছে, আলোকিত হয়ে উঠেছে সারা উঠানটা। ওপরে আকাশ অন্ধকার। গনগনে আগুনের শিখা যেন সে কালো আকাশ গিয়ে ছোঁয়। ওধারে ধোঁয়া হয়, শব্দ হয় ভাপের। যেন শত সহস্র্র সাপ শিস দেয়।”

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ‘ভারতবর্ষ’ গল্পে শীতের উপস্থিতিই হঠাৎ যেন প্রকট হয়ে ওঠে। “…সময়টা ছিল শীতের। বাজারে উত্তরে বিশাল মাঠ থেকে কনকনে বাতাস বয়ে আসছিল সারাক্ষণ। তারপর আকাশ ধূসর হল মেঘে। হাল্কা বৃষ্টি শুরু হলো। রাঢ়বাংলার শীত এমনিতেই খুব জাঁকালো। বৃষ্টিতে তা হলো ধারালো। ভদ্রলোকে বলে ‘পউষে বাদলা’। ছোটলোকে বলে ‘ডাওর’।”

হাসান আজিজুল হকের গল্পেও শীতের রং ও বিবর্ণতা অন্য মাত্রা আনে। শীতের হিম ঠান্ডা, ঝরা পাতার শব্দ, কনকনে হু হু বাতাস, শুকনো খাল বিল ডোবা, সাদা কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে চরাচর এমন সব বর্ণনা বিশেষ ভাবে পাওয়া যায় হাসানের ‘পরবাসী’ গল্পে।