তিনটি লেখা

এক

মহিষরেখা। নামটা শুনেই মনে হলো একটা অস্পষ্ট নিরুদ্দেশ আমাদের সামনে অপেক্ষা করে ঢাল দিয়ে বইছে। প্রকৃতির মেহেরবানি এভাবেই উপুড় করে রয়ে যায়। বোম্বে রোড বাগনানে ঢোকার আগেই চিৎ হয়ে থাকা দামোদরের ওপর যোগ চিন্হর মতো ব্রিজ পার করে ছুটছে। বিকেলের একটু আগেই হাইওয়ে ধরে একটা টেম্পো চেপে ওখানে এসেছিলাম। বিকেল শেষের আগেই গাছের ছায়া জলের ধার ঘেঁষে ঢেকে নেওয়ার চেষ্টায়। নদী নিজেই বইতে বইতে এগিয়ে যায় বহুদূর বহু বাঁকে ঘুরে ঘুরে তেজ হারালে আবার নিজেই লাশের মতো পড়ে থাকে। ব্রিজের নিচে যেখানটায় নদীর গা ঘেঁষে ফসল আবাদ তারপরেই জনবসতি দোকানপাট আর পনের বিশ ফুট কোথাও উঁচু পাড়ের রাস্তা ঢালাই করা যেন বাঁধের আড়াল। এবার হাঁটবো নদীর পাড় বরাবর রাস্তা দিয়ে কখনো একটু নেমে এসে নদীপ্রেম দেখানোর অছিলায় ছবি বন্দী করা। আমি আর অতীশদা প্রায় পাঁচ কিলো হেঁটে ঘুরলাম। ধনুকের বেড় করে এসে উঠলাম খাদিনান ঘাট। নদী থাকলে ঘাট থাকবে এটাই ধর্তব্য কিন্তু এখন আর ঘাটের কোনো নিশান নেই আবার ব্রিজ আর শেষবেলায় ঘোলাটে দামোদরের জলে কোথাও ছায়া কেঁপে উঠছে শেষ হেমন্তে সূর্য আড়ালে মগ্ন বা অন্য কোথাও চরের দিকে ছুটছে হয়তো।

দুই

গতকাল দশমীর দিনে মগরা স্টেশনে নামলাম বেলা এগারোটার পরে। অমিত আর সৈকত এসে অপেক্ষা করছিল বাইক নিয়ে। অমিতের নিমন্ত্রণ আমাকে সারাদিন জুড়ে। মগরা থেকে ড্যামরা গেলাম। কাছাকাছি একটা গ্রাম। সৈকতের বাড়ি ওখানে ওর পরিচয় ও পম্পার ভাই। উদ্যোগী মিশুকে ছেলে। ওদের সঙ্গে গ্রাম ঘুরে কুন্তী নদী দেখতে যাবো বললাম। মগরা আর আদিসপ্তগ্রামের একসময়ের নদী বাহিত গ্রামীণ বাণিজ্য চলত সরস্বতী আর কুন্তী নদী বেয়ে। এখন গঙ্গার এই শাখা নদী দুটোই খুব ক্ষীণ স্রোতহীন ঘোলা। কুন্তীর কাছে যেতে দেখলাম পাশেই বহু পুরনো একটা রিভার পাম্প। আদিবাসী জনবসতি সামান্য কয়েকঘর একদিকে ধানের জমি আর নদীতটে বৃক্ষ গুল্মে দুর্গম। ধাপহীন সামান্য একটু পথ নদীতে নেমেছে। কল্লোল নেই। আঁধার নামলে হয়তো আরও গম্ভীর হবে মানুষের জন্য অমসৃণ এই শান্ত পাড় টুকু। ফিরে এলাম ক্ষেত ভাগাড় নির্বিবাদী চুল্লুর আসর পেরিয়ে। সন্ধ্যেয় সাবেকি পুজোর কয়েকটা মণ্ডপ দেখে ব্ল্যাক ডগ ভাসিয়ে নিয়ে গেলো দশমীর বিসর্জন আর সিঁদুরখেলা।

তিন

এক একটা দিন সূর্য ওঠার বেশ কিছুটা পরে বিছানা ছেড়ে উঠে মশারির ফিতে গুলো খুলতে খুলতে মনে হয় সকালটা কী ক্ষমাসুন্দর! নিজের মধ্যে একটা উপভোগ্য সময় কল্পনায় এসে যায়। নিজের মধ্যে একটা ডিগনিফায়েড লোক হাঁটাহাটি করতে থাকে কিংবা গম্ভীর একটা ইজি চেয়ারে বসে থাকে। যেন একটা হ্যাপি ফিলিং আমার মধ্যে ঘোরাঘুরি করছে মনে হয় আবর্জনা ঝেঁটিয়ে সরিয়ে ফেলা বিপদমুক্ত একটা রাস্তা দিয়ে হাঁটছি কোনো তেমন হেলদোল নেই কোলাহল নেই অপ্রিয় মুখের সাক্ষাৎ নেই কোনো ইশারা নেই চাপিয়ে দেওয়া কাজের । একটা সত্যিই আজ অন্যরকম দিন আর পাঁচটা দিনের মতো মোটেই নয়। এত দিনের যাপিত বিরক্তি ক্লেদ ঘেন্না সেসব আমাকে ছেড়ে গেছে আমি ত্যাগ করতে পেরেছি যেন।

নিজেই ভাবলাম আই নেভার ফেল্ট বেটার লাইক দিস। দক্ষিণ দিকের জানালাটা খুলে দিলাম ইদানিং রাতে একটা ঠান্ডা লেগে যাওয়ার ভয় ছিল। আরও আলো এসে আমাকে আরেকটু উজ্জ্বল করে দিলো। গত রাতের বা গতকাল পরশুর কোনো কথাই আমার আজ মনে আসছে না সমস্ত ফোন এমনকি কিছুই না। মুখের সামনে আয়নাটা তুলে ধরলাম, কোনো অসুস্থতা বা চিন্তার ছাপ চোখে মুখে কপালে নেই। কিছুক্ষণ নিজেকে দেখলাম, তেমন  চিন্হই নেই মৃত্যুকে উপেক্ষা করে আমি আরও কয়েকটা বছর টক্কর দিয়ে কাটিয়ে দিতে পারব এমনই একটা ভাব , বাতেলা দেবো, অসময়ে বন্ধুর বাড়ির দরজায় টোকা দেবো বা ফোন করে বলবো এসেছি। দরজা খোলো। ফেরার পথে বাসে ফাঁকা লেডিস সিট থাকলে দিব্যি আয়েস করে পিঠ এলিয়ে বসবো অন্যমনস্কতার ভান করে তাকিয়ে থাকবো দূরে ফুটপাথে মেরুন ট্রাউজার পরা কোন ব্যস্ত লোকের হেঁটে যাওয়ার দিকে। বাড়ি ফিরে উপুড় হয়ে শুয়ে দুকাঁধ দুহাত ভাঁজ করে কপালের নিচে রেখে ভাববো আমার বাকি রাস্তাটুকু আলো জ্বলে আছে ওগুলো আর নিভবে না। তখন আমি তালু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে একরকম চাপা তারিফ করছি নিজেকেই রাশিফলের সমস্ত ফাঁদ কিভাবে আমি ফাঁকি দিয়ে দিব্যি মসৃণ প্রবৃত্তির মধ্যে জমাট হয়ে আছি কোনরকম কোরাপশনহীন শেষ অক্টোবরের সকালে।

ছবিঃ লেখক

Exit mobile version