এক নজরে

শীতে আর আসবে না ওঁরা

By admin

November 09, 2021

তপন মল্লিক চৌধুরী

ক্রিকেট, কমলালেবু আর সার্কাস- উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে এই ছিল কলকাতায় শীতের ট্রেডমার্ক৷ এখন ক্রিকেট ম্যাচ লেগে থাকে সারাবছর ধরেই,নাগপুর কিংবা দার্জিলিঙের কমলালেবুও বাজারে মেলে বছরের যে কোনও সময়, কিন্তু সার্কাস?  এত দূষণেও পরিযায়ী পাখিরা আসে কিন্তু পার্ক সার্কাস ময়দান, সিঁথির মোড় কিংবা হাওড়া ময়দানে পড়ে না সার্কাসের তাঁবু৷ একে একে কলকাতার জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছে কমলা সার্কাস, রেমন সার্কাস, গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস কিংবা অজন্তা সার্কাস৷ বাঙালির বিনোদন দুনিয়ায় টেলিভিশন আসার পরেও সার্কাসের জনপ্রিয়তা টাল খায়নি। বাঙালির উৎসব পার্বন ঘিরে যে মেলা বসে সেখানেও অবচ্ছেদ্য অংশ সার্কাস।

‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’-এ সত্যজিৎ রায় বাঙালির সার্কাসপ্রীতি ও এদেশে সার্কাসের ইতিহাস নিয়ে গল্পচ্ছলে লিখেছেন- কে জানত আজ থেকে একশো বছর আগে বাঙালির সার্কাস ভারতবর্ষে এত নাম কিনেছিল? সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল প্রোফেসর বোসের গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস। এই সার্কাসে নাকি বাঙালি মেয়েরাও খেলা দেখাত, এমনকি বাঘের খেলাও। আর সেই সঙ্গে রাশিয়ান, আমেরিকান, জার্মান আর ফরাসী খেলোয়াড়ও ছিল।… ১৯২০-তে প্রিয়নাথ বোস মারা যান। আর তার পর থেকেই বাঙালি সার্কাসের দিন ফুরিয়ে আসে। দিন ফুরিয়েছিল কিনা তা সঠিক বলা যায় না তবে এদেশের মাটিতে ১৮৭৯ সালে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল অঞ্চল দিয়ে প্রথম একটি রোমান সার্কাস দল হাজির হয়েছিল।

সেই রোমান সার্কাস দলের অন্যতম প্রধান ছিলেন উইলিয়াম সিরিন| ইতিমধ্যেই তাঁর ও দলের বেশ নামডাক কুড়িয়েছিল। এদেশে এসে উইলিয়াম সিরিন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছিলেন যে তাদের মতো খেলা আর কেউ দেখাতে পারবে না। সেই চ্যালেঞ্জের জবাব দিয়েছিলেন তৎকালীন মারাঠা সম্রাট কুরুওয়ানদান| ভারতীয় সার্কাসের যাত্রা শুরু তাঁর বাজি জেতা দিয়েই| এদেশে প্রথম সার্কাস দল গড়ে ওঠে কুরুওয়ানদানের পৃষ্ঠপোষকতায়।এরপর কেরালা, কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাও হয়ে ওঠে সার্কাসের অন্যতম পীঠস্থান| কলকাতার শীতে সার্কাশের আসর বসত ইংরেজ আমলেও। তখনও তাঁবু খাটিয়ে বন্য জন্তু-জানোয়ারদের নিয়ে খেলা দেখাতে আসতো বিভিন্ন সার্কাস দল|

‘সার্কেল’ শব্দ থেকেতৈরি হওয়া সার্কাস কথাটির মানে হল গোলাকার লাইনের ওপর দিয়ে ঘোরা। প্রাচীন গ্রিসে ঘোড়ারা লোহার তৈরি গোলাকৃতি লাইনের ওপর ঘুরতে ঘুরতে বিভিন্ন ধরনের খেলা দেখাতো। আর সেখান থেকেই রচিত হয়েছিল বিশ্ব সার্কাসের ইতিহাসের প্রথম অধ্যায়। পরবর্তীতে ঘোড়ার সঙ্গে হাতি, বাঘ, সিংহ নিয়ে মানুষও যুক্ত হলো সেই প্রাচীন খেলায়। বন্য পশু এবং মানুষের শারীরিক কসরতের খেলার নাম হয়ে গেল সার্কাস। গ্রিসের পর রোম পশ্চিমের বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠল সার্কাস।

তবে ‘সার্কাস’ নামকরণ করেছিলেন ব্রিটিশ গীতিকার, সুরকার, লেখক ও অভিনেতা চার্লস ডিবডিন। রোমে প্রথম সার্কাসটি ছিল সার্কাস ম্যাক্সিমাস। এর পরের নামগুলি যথাক্রমেসার্কাস ফ্ল্যামিনিয়াস, সার্কাস নেরোনিস এবং সার্কাস ম্যাক্সেনটিয়াস। তারতুলিয়ন-এর লেখা বই ‘দি স্পেকটাকুলিস’ থেকে জানা যায়বাবা হেলিয়সের(সূর্যদেব)জন্য প্রথম সার্কাসের খেলা দেখিয়েছিলেন দেবী সিরসে। তবে, আজকের সার্কাসের জনক হলেন ইংল্যান্ডের ফিলিপ অ্যাসলে। ১৭৬৮ সালে তিনিপ্রথম সার্কাসে ঘোড়া নিয়ে নানারকম কসরত দেখান। ১৭৭০ সালে তাঁর সার্কাসে যোগ হয় অ্যাক্রোব্যাটিক স্কিল, দড়ির উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া, জাগলিং শো এবং জোকারের ভাঁড়ামি। সার্কাসের ইতিহাসে প্রথম জোকার হিসেবে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে ব্রিটিশ অভিনেতা জোসেফ গ্রিমালদির নাম। আর ট্রাপিজের খেলার জন্মদাতা বলা হয় ফরাসি অ্যাক্রোব্যাট জুলস লিওটার্ডকে।

বাঘ সিংহের খেলা বন্ধ হওয়া ইস্তক সার্কাসের জৌলুসই কমে গিয়েছে। নোট বাতিলের ৮ নভেম্বরের পর থেকে অবস্থা আরও করুণ। তাই শীতের সন্ধ্যায় ঝমঝমিয়ে ওঠে না বাজনা। হাততালি, শিস, মুখে ঠিকরে পড়া আলো উধাও। ফিসফিসিয়ে কে যেন বলে ওঠে জিনা য়হাঁ, মরনা য়হাঁ, ইসকে সিবা জানা কাহাঁ…