এক নজরে

তদন্তে নজর গরু আর বাংলাদেশে

By admin

February 18, 2021

কলকাতা ব্যুরো: মন্ত্রীর খাস তালুকে বোমা বিস্ফোরণে তাকে খুনের চেষ্টার ঘটনায় রাজ্য রাজনীতি একেবারে সরগরম। রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী জাকির হোসেনকে বুধবার রাতেই গুরুতর অবস্থায় কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে মুর্শিদাবাদ থেকে আনা হয়েছে। একই সঙ্গে ওই ঘটনায় জখম হয়েছেন অন্তত ২৫ জন। বেশ কয়েকজনকে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় পাঠানো হয়েছে। এদিকে এই ঘটনায় তদন্তের জন্য এডিজি সিআইডির নেতৃত্বে একটি সিট গঠন করেছে রাজ্য সরকার। সেই দলে দক্ষ পুলিশ অফিসারদের রাখা হচ্ছে। কিন্তু মুর্শিদাবাদের অন্যতম বিত্তশালী ব্যবসায়ী জাকির হোসেনকে এইভাবে তার খাস তালুকে খুনের চেষ্টার কারা জড়িত তা নিয়ে জোর আলোচনা রাজ্যে।আইইডি বিস্ফোরণের আশঙ্কা—-

ইতিমধ্যেই পুলিশ এনিয়ে খোঁজখবর শুরু করেছে। এলাকায় জাকির হোসেনের মতো প্রভাবশালীকে খুনের চেষ্টা কারা করতে পারে তা নিয়ে এখন রীতিমতো তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। ইতিমধ্যেই সোর্সদের কাজে লাগিয়ে বিস্ফোরণের পিছনে কারা রয়েছে তার ক্রু পাওয়ার চেষ্টা করছেন তদন্তকারীরা। এদিন ঘটনাস্থল থেকে ব্যাটারির টুকরো, বিদ্যুতের তারের অংশ উদ্ধার করেছেন তদন্তকারীরা। ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য সেসব পাঠানো হয়েছে। ফলে রিমোট কন্ট্রোলে আই ই ডি বিস্ফোরণের আশঙ্কা এখনই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না আর তাহলে এক্ষেত্রে কোন জঙ্গী সংগঠনকে এই কাজে লাগানো হয়েছিল কিনা সেটাও দেখার।একদিকে ব্যবসায়ী, অন্যদিকে যথেষ্টই এলাকায় দান করে প্রতিপত্তি এবং সুনাম অর্জন করেছেন জাকির হোসেন। পাশাপাশি তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিয়ে রাজ্যের মন্ত্রী হয়েছেন। ফলে একদিকে যেমন তার ভক্ত সংখ্যা কম নয়, তেমন পয়সার উল্টো দিক রয়েছে। ফলে তার শত্রু সংখ্যাও কতটা ছিল তা নিয়েই এখন ফের হিসেব-নিকেশ শুরু হয়েছে মুর্শিদাবাদে।

আলোচনায় সেই এনামুল ও গরু পাচার —-

জাকির হোসেনকে এইভাবে খুনের চেষ্টার কারণ খুঁজতে গিয়ে উঠে আসছে গরু পাচার এবং তাকে অভিযুক্ত হয়ে গ্রেপ্তার হওয়া এনামুল হকের নামও। বছর দুয়েক আগেই এনামুল হকের বিরুদ্ধে গরু পাচার নিয়ে সক্রিয় হয়েছিলেন এলাকার বিধায়ক তথা মন্ত্রী জাকির হোসেন। এই কাজে পুলিশের একাংশের ভূমিকা নিয়ে রীতিমতো মুখ্যমন্ত্রীর কাছে নালিশ পর্যন্ত করেছিলেন তিনি। জেলার এক প্রভাবশালী পুলিশের শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গে সে সময় তাঁর ঠান্ডা লড়াই ছিল জেলার রাজনীতিতে একটা আলোচনার বিষয়। এখন এনামুল সিবিআইয়ের গরু পাচার মামলায় জেলে রয়েছেন। অথচ জঙ্গিপুরে, বাংলাদেশ সীমান্তে এখনো পাচার অব্যাহত। সেখানেই যারা এই পাচারের সঙ্গে যুক্ত, কোনভাবে মন্ত্রী তাদের আটকানোর চেষ্টা করছিলেন কিনা, সেই প্রশ্ন এখন উঠছে। আবার নাকি এনামুল না থাকার সুযোগে অন্য একটা প্রভাবশালী অংশ ওই পাচারের নিয়ন্ত্রক হতে চাইছিল, প্রশ্ন রয়েছে তা নিয়েও। এই পরিস্থিতিতে এলাকার প্রভাবশালী মন্ত্রীকে সরিয়ে দিতে গরু পাচারের অভিযুক্তরা সুপারি দিয়ে বাইরে থেকে খুনের জন্য লোক এনেছিলো কিনা, এটাও এখন পুলিশের তদন্তে আওতায় চলে এসেছে।

রিমোটে বিস্ফোরণ!

বুধবার রাতেই নিমতিতা স্টেশন ওই জায়গা ঘুরে দেখেন পুলিশ কর্তারা। বৃহস্পতিবার সকালে সিআইডি ও ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ঘটনাস্থলে যান। প্রথমে বোমাটিকে ক্রুড বোমা বা সকেট বোমা বলে মনে করা হলেও, এখন পুরোপুরি সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছেন না পুলিশ অফিসাররা। আর বিদ্যুতের তার ও ব্যাটারি পাওয়ায় বিষয়টি আরো জটিল দিকে মোড় নিল বলে মনে করছেন বর্ষীয়ান পুলিশ অফিসাররা। যারা ওই ঘটনায় জখম হয়েছেন, যেভাবে বিস্ফোরণের অভিঘাতে তারা দূরে ছিটকে পড়েছেন, তাতে এটি সামান্য হাতে তৈরি বোমা বলে নিশ্চিত হতে পারছেন না। নিমতিতা স্টেশন এর যে জায়গাটিতে ঘটনা ঘটেছে, তা উপরে এখন শেড তৈরীর কাজ চলছে। ফলে প্রচুর পরিমাণে ইট, সিমেন্ট এবং লোহালক্কর জমা করা রয়েছে। তারই মধ্যে আগে থেকে বোমাটি রেখে দেওয়া হয়েছিল বলে মনে করছেন অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসাররা। মন্ত্রী ওই জায়গায় দিয়ে যাওয়ার সময় তা দূর থেকে রিমোটের মাধ্যমে বিস্ফোরণ ঘটানো হয় বলে ধারণা পুলিশ অফিসারদের। মুখ্যমন্ত্রী বৃহস্পতিবার কলকাতাতেও একই আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ যোগের আশঙ্কা—

এইখানে প্রশ্ন উঠছে আততায়ীদের সম্পর্কে। তাহলে কি বাংলাদেশ থেকে ভাড়াটে খুনিদের এনে এই অপারেশনে কাজে লাগানো হয়েছিল! যদিও পুলিশ এখনো প্রাথমিক তদন্তের মধ্যেই রয়েছে। সেক্ষেত্রে সীমান্তে পাচারের নিয়ন্ত্রকরা এখন সিবিআই তদন্ত এবং ধরপাকড়ের চাপে পড়েছে। তারাই ঘটনার পিছনে, নাকি এলাকাতে জমি নিয়ে কারবারিদের এতে হাত রয়েছে, সেদিকেও নজর রয়েছে পুলিশের। কারণ মুর্শিদাবাদের দুষ্কৃতীদের দিয়ে মন্ত্রীকে খুনের চেষ্টা হলে পিছনের মাথাদের খুব দ্রুত ধরা পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। আর যেহেতু সীমান্তে চোরাকারবার এই এলাকার একটা বড় অংশের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে, তাই ওপারের অপরাধীরাও খুব সহজেই এপারে ঢুকে অপরাধ করে বেরিয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে এর পিছনে থাকা মাথাদের ধরা পড়ার আশঙ্কা কমে যায়।

জমি কারবার–

ধুলিয়ানে জাকির হোসেনের বাড়ি থাকলেও, জঙ্গিপুরেও তার বাড়ি রয়েছে। বিড়ির ব্যবসা থেকে শুরু করে রাইস মিল, এডুকেশন সেন্টার সহ বহু ব্যবসার মালিক জাকির হোসেন। তাছাড়া এলাকায় গত কয়েক বছর ধরে প্রচুর জমি কিনেছেন তিনি। ব্যবসায়ী হিসেবে সেইসব জমিতে নতুন নতুন বাড়িঘর কোথায় তৈরি হয়েছে, কোথাওবা ফাঁকা পড়ে রয়েছে জমি। জঙ্গিপুরের এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার বক্তব্য, এই মহকুমার বেশিরভাগ বিক্রির অবস্থায় থাকা জমির মালিক এখন জাকির হোসেনের সংস্থা। ফলে সেই জমি কেনা বা বিক্রি নিয়ে অথবা এলাকার অন্য কোনো প্রভাবশালী অংশের সঙ্গে জমি নিয়ে তার গণ্ডগোল, এই ঘটনার পিছনে কিনা, তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। ধুলিয়ান এলাকায় জাকির হোসেনের মতো বহু বড় বড় ব্যবসায়ী রয়েছেন। যাদের একটা বড় অংশই বিড়ির সঙ্গে যুক্ত। তা ছাড়া অন্যান্য নানান রকম ব্যবসাতেও তারা যুক্ত।

বেশি ভিড়েই কি আততায়ীরা লক্ষ্যভ্রষ্ট?

মন্ত্রীকে খুনের চেষ্টা হলেও শুধুমাত্র একটি বোমা ফাটিয়েই কেন আততায়ীরা রণে ভঙ্গ দিল, তা নিয়ে সন্দিহান মুর্শিদাবাদে কাজ করা বহু অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসার। তাদের অভিজ্ঞতা, কাউকে ভয় দেখানোর জন্য আহত করার তেমন নজির মুর্শিদাবাদে নেই। সে ক্ষেত্রে জাকির হোসেন বিস্ফোরণে শুধু জখম হলেন। এর পেছনে অন্য কোন ঘটনা আছে কিনা তাও ভাবাচ্ছে পুলিশ অফিসারদের। যদিও এক পুলিশ অফিসার বলেন, ঘটনাচক্রে মন্ত্রী বুধবার অন্যদিনের তুলনায় তার সূচি একটু বদল ঘটিয়েছিলেন। তাতেই তিনি প্রাণে বাঁচলেন বলে মনে করছেন অনেকে। তৃণমূলের জেলা সভাধিপতি মোশারফ হোসেনকে সরানোর জন্য বুধবার প্রায় সাড়ে তিন- চার ঘন্টা বহরমপুরে বৈঠকে ছিলেন জাকির হোসেন। আবার এইদিন টেট পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়। এলাকার বহু যুবক তাতে সুযোগ না পেয়ে মন্ত্রীর কাছে দরবার করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু এদিন সভাধিপতিকে সরানোর বৈঠক এতটাই দীর্ঘায়িত হয় যে, তিনি আর সেখানে ওই পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে বেশিক্ষণ কথা বলতে পারেননি। তাই তিনি তাদের স্টেশনে দেখা করার জন্য বলেছিলেন। এরই মধ্যে বহরমপুর থেকে বেরিয়ে তিনি বাড়ি গিয়ে সামান্য কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে নিমতিতা স্টেশনে পৌঁছে যান। অন্যদিন এই সময় তিনি ট্রেন ধরতে আসলে সাধারণভাবে দুজন নিরাপত্তারক্ষী সহ সর্বসাকুল্যে সাত – দশ জন তার সঙ্গে স্টেশন পর্যন্ত আসেন। কিন্তু এদিন টেট পরীক্ষার্থীদের দৌলতে সেই সংখ্যাটা একশোর উপরেই ছিল। ফলে আততায়ীরা এই মানুষের ভিড় হিসেবের মধ্যে আগে রাখতে পারেনি। ফলে এত লোকের মধ্যে বোমা মেরে, তারপরে গুলি চালানোর রিস্ক নিতে না পারাতেই হয়ত এই যাত্রায় বড় বিপদ থেকে মন্ত্রী বেঁচে গিয়েছেন বলে ধারণা পুলিশ কর্তাদের।

রাজনীতির ঘূর্ণিপাক—যদিও আবার রাজনৈতিক কারণেই হিংসায় তাকে এমন হামলা হল কিনা তা নিয়েও চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ কংগ্রেস বা তৃণমূলের একটা প্রভাবশালী অংশের সঙ্গে জাকির হোসেনের সখ্যতা থাকলেও, তার রাজনীতিতে শত্রু ছিল যথেষ্ট। ফলে সে দিক গুলোও দেখছে পুলিশ। পুলিশ গোটা ঘটনায় সব দিক খতিয়ে দেখছে।