এক নজরে

কবেকার অন্তরঙ্গতার দাগ

By admin

December 05, 2023

হঠাৎ রেলগাড়ি যদি অনাদিকালের জন্য থেমে যায় অঘ্রাণের কোন মেঠো প্রান্তরে। যেখানে আনমনা পথিকের অপেক্ষায় পথের ধুলোবালির চোখে ক্লান্তি ঘিরে ফেলে। মেঠো ফুলের খিলখিল হাসির খাঁজে খাঁজে যেখানে মুগ্ধ প্রজাপতি তিরতির করে কেঁপে ওঠে। যেখানে উতলা বাতাসের উদাসী প্রলাপে জলফড়িঙের মতো ভেসে থাকে পরিত্যক্ত প্রেম।  

ব্যস্ত যাত্রীরা নেমে গেছে সবাই এক এক করে। পড়ে রইলাম শুধু বিবর্জিত আমি। সঙ্গে থেকে গেল ছায়া নিঝুম অপরাহ্ণ। ঘোলাটে দিগন্ত। রেলগাড়ির শুনশান কামরা। মন কেমনের উদাস জানালা। চাক চাক ছায়া-রৌদ্র দিনভর লুকোচুরি খেলে ঝিরিঝিরি পাতার ফাঁকফোকরের আহ্ললাদে।  

কেউ একদিন বলেছিল। যেদিন নদীতীরের থুড়থুড়ে বটের ঝুরিতে শিশির এসে বিন্দু বিন্দু মুক্ত জ্বেলে দেবে, উতল আকাশের আকুলতা মুঠোয় ভরে সে ঠিক সামনে এসে দাঁড়াবে। এলোকেশে আছড়ে পড়বে হিল্লোলিত জলপ্রপাত। ছলছল চোখের পাতায় দুলে উঠবে উদ্বেল ইছামতী। শিশির সিক্ত টোল পরা গাল বেয়ে নেমে আসবে দুর্বার আকুতির দুর্নিবার মন্দাকিনী।

পাতাঝরা ঝোপঝাড়ে নির্জনতার ভিড় জমাট হলে, ঝাঁক ঝাঁক জোনাকি এসে শিরা-উপশিরায় সুড়ঙ্গ খোঁড়ে। টিমটিমে আলোর পথ বেয়ে প্রায় ভুলে যাওয়া আবছায়ারা একে একে উঠে আসে। ঝরা পাতার নিস্তরঙ্গ হৃৎপাঁজরে হঠাৎ যেন কাঁপন লাগে। 

কমলা সূর্যটা দিগন্ত টপকে ঝুপ করে গলে পড়লেই, ঘাসের ডগায়, পাতার তালুতে ফোঁটা ফোঁটা কান্না এসে জড়ো হয়। ছলছল চোখের সেই মেয়েটা কুয়াশা আড়াল ছিঁড়ে পাশে এসে বসে। অনাদরে বেড়ে ওঠা লতাগুল্ম তাঁর নারকেল পাতার মতো আঙুল ছুঁয়ে ফেলে। চোখের জানালায় প্রদীপ জ্বেলে সে জানতে চায়, মনে পড়ে ঝুপ্পুস সকালে পাহাড় বেয়ে গলে পড়া ফোঁটা ফোঁটা সেই কথাগুলো?

কি কথা, কি কথা? মরচে ধরা স্মৃতির বাক্সটা আমি তোলপাড় করে ফেলি। কিছুই যে মনে পড়ে না আর! বইয়ের ভাঁজে চুপসে থাকা কবেকার সেই শুকনো গোলাপ কেবল ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। রূপালী নদী-গর্ভের অন্তরে বয়ে যাওয়া কুলুকুলু চোরাস্রোত পরিত্যক্ত ভালোবাসার হাড়পাঁজর খুঁজে মরে। দূর থেকে মাদলের আওয়াজ ভেসে আসে। পথ ভুল করা হাতির পাল চিল-চিৎকার করে ওঠে। পাতাঝরা জঙ্গলের হৃৎপাঁজরে সেই কবেকার অন্তরঙ্গতার দাগ আজও নিশ্চই লেগে আছে!      

ঝাপসা হেমন্তের নির্জন সন্ধ্যার মায়ার কোঠরে আঙুল ছুঁয়ে কেউ একদিন বলেছিল। সে কত কথা। যা বলেনি, তা যত্ন করে জমা রেখেছিল শ্রাবণী মেঘেদের জিম্মায়। কিন্তু সে তো আমার দুখজাগানিয়া রাতের অঝোর ধারা ছিল না কখনও! আমার বিনিদ্র রাতের চন্দ্রমল্লিকাও ছিল না কোনদিনও! অথচ যেদিন শুনশান দুপুরে বৃষ্টি হয়ে গলে পড়েছিল গুম মেরে থাকা সেই না-বলা কথাগুলো, সেদিন দুচোখের কানায় কানায় ফোঁটা ফোঁটা মুক্তোর মিছিল স্থবির হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল।

ধোঁয়া ধোঁয়া কুয়াশা হাতে মেখে, এই নির্জন মেঠো পথ ধরে, এই নিঃসঙ্গ রেললাইন বেয়ে, স্বপ্ন বোঝাই কত উদাসী মন যে অন্তহীন পথ হেঁটে গেছে, কে জানে! হেমন্ত সন্ধ্যায় তাঁদের প্রেতাত্মা এসে ভড় করে হিমেল হাওয়ার শরীরে। পাতার শরীর ছিঁড়ে লাল চাঁদ এসে উঁকি মারে শিশিরের গোপন কোঠরে। রাত গভীর হলে, ঘোলাটে জ্যোৎস্না চুপি চুপি এসে শরীরের ওম খোঁজে জীর্ণ প্রেমের পাঁজরের খাঁজে।

লেখক অধ্যাপক, সমাজ, রাজনীতি ও পরিবেশ বিশ্লেষক