এক নজরে

বাসের নাম -বিপ্লবী

By admin

September 02, 2023

মুরারীপুকুর বাগান বাড়িতে আসার আগে বিভূতিভূষণ তাঁর আত্মকথনে বলেছেন একটি রোমহর্ষক পটভূমি। সেই দিকটি নিয়ে দু’চার কথা বলতেই হয়। ছোটবেলায় শান্তিপুরের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে সপরিবারে এলেন বাঁকুড়ায়। আগেই বলেছি, তাঁর বাবা সারদা প্রসাদ সরকারের বদলির চাকরি। এবার বাঁকুড়া থেকে জাতীয় বিদ্যালয়ে পড়তে এলেন কলকাতার জাতীয় বিদ্যালয়ে। উঠেছিলেন  ৪১ নং চাঁপাতলা ফার্স্ট লেনের “যুগান্তর” বোর্ডিং-এ। ১৯০৬ সালের এপ্রিল মাস নাগাদ প্রফুল্ল চাকীর সঙ্গে তাঁর প্রথম আলাপ হয় এই ঐতিহাসিক ছাত্রাবাসে। এখানে তাঁর মতো অনেক ছাত্রই থাকতেন। যেমন- তাঁর মামাতো ভাই ডা: কালীকৃষ্ণ মিত্র, হরেন্দ্রকৃষ্ণ মিত্র, অবিনাশ ভট্টাচার্য এবং ওই সময়ের বিখ্যাত ও অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিপ্লবী নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। পরবর্তীকালে তিনিই হলেন বিপ্লবীদের বিপ্লবী এমএন রায়। তাঁদের সঙ্গে যোগসূত্র ঘটে গুপ্ত সমিতির বিপ্লব মন্ত্রে দীক্ষিত সন্তানদের ।প্রফুল্ল চাকীর মতো প্রফুল্ল চক্রবর্তী, নলিনীকান্ত সরকার সহ আরো অনেকের সঙ্গে বিভূতিভূষণের যোগসূত্র ঘটে। নলিনীকান্ত থাকতেন ৪৪ নং হ্যারিসন রোডের মেসবাড়িতে। তিনি অবশ্য পড়াশোনা করতেন প্রেসিডেন্সিতে। বিভূতিভূষণ নিয়মিত আসতেন এই ছাত্রাবাসে। এখানে প্রথম আলাপ হয় সুধীর কুমার সরকারের সঙ্গে। তিনিও নিয়মিত আসতেন নলিনীকান্ত’র কাছে। বিভূতিভূষণ বলেছেন-“আমরা নামমাত্র স্কুলের পড়ুয়া ছিলাম কিন্তু আমাদের মন পড়িয়া থাকিত অন্য জায়গায়। আমি সমিতির বাহিরে থাকিয়া কিছু কিছু কাজ করিতাম। ১৯০৪ সালে আমি বোর্ডিং ছাড়িয়া যোগেন্দ্রনাথ সরকারের সহিত মেদিনীপুরে যাই। সেখানে সত্যেন্দ্রবাবুর অধীনে বন্দেমাতরম তাঁতশালায় কার্য করিতাম। আমরা তথায় পাঁচজন ছাত্র থাকিতাম। দ্বিজেন্দ্র বিশ্বাস, জ্ঞান পরামাণিক, নিরাপদ রায়, ক্ষুদিরাম ও আমি।”

তখন থেকেই মেদিনীপুরের মাটিতে গড়ে উঠেছিল বিপ্লববাদের পাঠশালা। যেখানে শেখানো হয় সাহেব নিধনের পাঠ আর বিলিতি বর্জনের কৌশল। তার সঙ্গে দেহ চর্চা ও অস্ত্র শিক্ষা। পাশাপাশি হ্যান্ডবিল, পত্রপত্রিকা বিলি ও পোস্টার সাঁটানোর মতো জনমত গঠনের কাজগুলোও করতেন তাঁরা। স্বদেশপ্রেমের বার্তাবাহকদের উপর ছিল ব্রিটিশের তীক্ষ্ণ নজরদারি। আর এই সব কাজগুলো করতে হতো শাসকদের নজর এড়িয়ে। আবার কয়েকজন তো প্রকাশ্যেই এই সব কাজ করে দুঃসাহসিকতার পরিচয় রেখেছেন। পিকেটিং, বিলিতি বর্জন ও বন্দেমাতরম পত্রিকা বিলি করতে গিয়ে ত্রাস হয়ে উঠেছিলেন ব্রিটিশপুলিশ ও গোয়েন্দা বাহিনির নজরে। সমিতির গোপন ডেরায় শেখানো হয় মায়ের নামে সশস্ত্র সংগ্রামের পাঠ। অর্থাৎ মেদিনীপুরই হয়ে উঠেছিল ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্র। আর মুরারীপুকুর ছিল আত্মাহুতির যজ্ঞশালা।

এমনি ভাবে একদিন মেদিনীপুরেই বিভূতিভূষণের সঙ্গে ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকার ঘটে বারীণ্দ্রনাথ ও ঋষি অরবিন্দের সঙ্গে। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন প্রফুল্ল চাকী। এই চরম সন্ধিক্ষণেই বিপ্লবী কর্মকান্ডের মাস্টার মাইন্ড সত্যেন্দ্রনাথ বসু বারীণ ও অরবিন্দকে বললেন- “এই ছেলেটিকে তোমরা নিয়ে যাও। এ তোমাদের কাজের অর্থাৎ সক্রিয় বিপ্লবী কার্যের উপযোগী। “বিভূতিভূষণকে গুরুদায়িত্ব দেওয়ার জন্য সত্যেনের এই পরামর্শে বারীণ, অরবিন্দ ‌সিলমোহর দিয়ে‌ দিলেন। বিভূতিভূষণের কপালে আত্মবলিদানের জয়টিকা এঁকে দিলেন অরবিন্দ ও বারীণ। এই মেদিনীপুর থেকেই শুরু হল মাতৃবন্দনা আর দেশমাতৃকার শেকল ভাঙার মন্ত্রপাঠ। মুরারীপুকুর বাগান বাড়িতে ঠাঁই হলো বিভূতিভূষণের। তাঁর সঙ্গেই থাকতেন বারীণ্দ্রনাথ, প্রফুল্ল চাকী, হরিশ, শান্তি সহ আরও কয়েকজন বাঙলা মায়ের দামাল ছেলে। সুধীর সরকারও যোগ দিতেন মাঝে মাঝে। তিনি একদিন থেকে পরের দিন চলে যেতেন কাজ হাসিলের লক্ষ্যপূরণের তাগিদে। কি হতো এখানে? কেনই বা আসতেন বাগানবাড়িতে? তার সব প্রশ্নের রোমহর্ষক উত্তর দিয়েছেন বিভূতিভূষণ। ঝাঁকে ঝাঁকে নিয়মিত যোগ দিতেন বাঙলা মায়ের আগুন পাখির দল। আসতেন দেশের নানা প্রান্তের মুক্তিযোদ্ধার দল।

(চলবে)