আচমকা কান-ফাটানো আওয়াজ। পাশে দাঁড়ানো নিরাপত্তাকর্মী বিয়ন্ত সিং রিভলবার বার করে তাঁর দিকে গুলি চালায়।প্রথম গুলিটা এসে লাগে পেটে। তিনি ডান হাতটা ওপরে তুলেছিলেন গুলি থেকে বাঁচতে। তখন একেবারে পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে বিয়ন্ত সিং আরও দুবার গুলি চালায়। সে-দুতি গুলি লাগে তাঁর বুকে আর কোমরে।ঠিক পাঁচ ফুট দূরে নিজের টমসন অটোমেটিক কার্বাইন নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সতবন্ত সিং। তাঁকে মাটিতে পড়ে যেতে দেখে সতবন্ত বোধহয় কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিল। স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে ছিল। মুহূর্তের স্তব্ধতা ভেঙে কার্বাইন চালাতে শুরু করলেন সতবন্ত। রক্তে রাস্তা ভেসে গেল। সেই রক্তের ওপর পড়ে রইল নিথর দেহ…
এই ঘটনার আগের দিন ভুবনেশ্বরে গিয়েছিলেন তিনি। সূচি অনুযায়ী মঞ্চে হাজির হয়েছিলেন বক্তৃতা দিতে। প্রতিবারের মতো এবারও ভাষণের খসড়া এগিয়ে দেন এইচ ওয়াই শারদাপ্রসাদ। কিন্তু তিনি তো খসড়ার বাইরে চলে যাচ্ছেন। ‘আমি আজ আছি, কাল নাও থাকতে পারি। কিন্তু আমার মনে কোনো অনুতাপ নেই। অনেকদিন বেঁচেছি। যে কদিন বেঁচেছি, দেশের কথা ভেবেছি।’ তবে কি রক্তের দাগ তিনি আগেই দেখতে পেয়েছিলেন। তা না হলে প্রতিতি কথায় আসন্ন মৃত্যুর পূর্বাভাস কেন? এমনভাবে তো এর আগে তাঁকে দেখা যায়নি! সেদিন কী হল হঠাৎ, যে তাঁর পুরো ভাবই বদলে গিয়েছিল? ওড়িশার রাজ্যপালও অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। খুব তাড়াতাড়ি দিল্লি ফিরে গিয়েছিলেন। রাতে ভাল ঘুমোননি।
এর কয়েকদিন আগে তাঁর কাছে গোয়েন্দা প্রধানরা এসে জানিয়েছিলেন, গোপন সূত্রের খবর, প্রধানমন্ত্রীর ওপর হামলা হতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তারক্ষীদের থেকে শিখদের বাদ দিয়ে দেওয়া হোক। কিন্তু এমন প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দিয়েছিলেন ইন্দিরা। কাউকে বের করা যাবে না। প্রসঙ্গত, বেশ কয়েকটি রাজ্য কেন্দ্রীয় সরকার থেকে স্বাধীনতা দাবি করতে শুরু করেছিল ইন্দিরার ৪র্থ দফার প্রধানমন্ত্রীত্বে। যার মধ্যে অন্যতম ছিল পাঞ্জাব। সন্ত জার্নাইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালের নেতৃত্বে স্বতন্ত্র ভূখন্ড ‘খালিস্তান’ এর দাবিতে শিখরা আন্দোলন শুরু করে। ১৯৮২-র জুলাই মাসে জার্নাইল সিং অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে অবস্থান নেন এবং শিখ বিদ্রোহকে আন্দোলিত করেন। ১৯৮৪ সালের জুন মাসে ইন্দিরা শিখ বিদ্রোহ দমন করতে স্বর্ণমন্দিরে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে অপারেশন ব্লু-স্টার পরিচালনা করেন। ভারতীয় সেনাদের হিসাব অনুযায়ী ৪৯৩ জন শিখ বিদ্রোহী এবং সেনাবাহিনীর ৪ অফিসারসহ ৮৩ জন নিহত হন। অপারেশন ব্লু-স্টার চলেছিল ৬ জুন, যেদিন স্বর্ণমন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা অর্জন দেবের মৃত্যুবার্ষিকী। সেদিন প্রচুর শিখ তীর্থযাত্রী আসে স্বর্ণমন্দিরে। তার মানে যত বেশি সংখ্যক শিখ হত্যা করে বিদ্রোহ দমন করাই আসল লক্ষ্য। পরবর্তী সময়ে পাঞ্জাবের গ্রামাঞ্চলকে বিচ্ছিন্নতাবাদমুক্ত করতে ভারতীয় আধাসামরিক বাহিনী নামানো হয়।
পবিত্র স্বর্ণমন্দিরের অবমাননা আর খালিস্তানের স্বপ্ন ভেঙে দেওয়ার প্রতিশোধ নিতে ৩১ অক্টোবর ১৯৮৪, সাৎওয়ান্ত সিং ও বেয়ান্ত সিং নামে নিজের দুই শিখ দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হন ইন্দিরা। শিখ দেহরক্ষী ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যা করার পর দেশজুড়ে দাঙ্গা বাধে। আট হাজারের মতো লোক নিহত হয়। দিল্লিতেই নিহত হয় তিন হাজার। দাঙ্গা চলে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত। সিবিআই-এর মতে দিল্লি পুলিশ এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কিছু কমকর্তার সহায়তায় এই দাঙ্গা চলে। মায়ের মৃত্যুর পর রাজিব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরই বলেছিলেন বড় গাছ যখন পড়ে, তখন মাটি কাঁপে। দেশে জরুরি অবস্থার সময়ে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলনরত হাজার হাজার শিখকে আটক করে কারাগারে রাখা হলে শিখরা মাঝে মধ্যেই হামলা চালালে সরকার বলত সন্ত্রাসবাদী। ইন্দিরা হত্যার পর সরকারি রিপোর্ট অনুসারে, দু’হাজার ৭০০ জন শিখ নিহত হয়। দিল্লি থেকে ২০ হাজার শিখ বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়।