এক নজরে

Tarun Majumder : আলোর খোঁজে চাঁদের বাড়ি 

By admin

July 06, 2022

সিনেমা একটি শক্তিশালী শিল্পমাধ্যম বা আরও কিছু সেই ভাবনা তো বিগত শতাব্দীর চল্লিশের দশকেই মাথাচাড়া দিয়েছিল। পরবর্তীতে সত্যজিৎ, মৃণাল, ঋত্বিকের হাত ধরে অন্য ধরণের সিনেমা নির্মাণের প্রস্তুতি পর্ব প্রায় সাড়া হয়ে যায়। বলা বাহুল্য পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই বাংলা সিনেমার নির্মান-ভাবনা অন্য দিকে মোড় নেয়। বিশেষ করে সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালীর নির্মাণ-ভাবনা থেকে শুরু করে শিল্পরূপ, পাশাপাশি ছবিটির অভাবনিয় সাফল্য বোধসমৃদ্ধ চলচ্চিত্রের আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলা ছবির পরিচিতি ঘটায়। কেবলমাত্র সত্যজিৎ নন, তাঁর সমসাময়িক বাংলা চলচ্চিত্রের অন্য দুই গুরুত্বপূর্ণ পরিচালক ঋত্বিক ঘটক ও মৃণাল সেনও প্রায় একই সময়ে বাংলা চলচ্চিত্রশিল্পে পা রেখেছিলেন। একই সময়ে এই তিনজনের সৃষ্টির উড়ানে চেপেই বাংলার চলচ্চিত্রশিল্প বিশ্ব চলচ্চিত্রের আসরে গৌরবময় আসন পায়।

বাংলা ছবির সেই নতুন অধ্যায়ের সুচনায় কেবল এঁদের নয় উচ্চারণ করতে হয় আরও অনেকের কথা যারা শুধু ছবি তৈরির জন্যই নয়,  পাশাপাশি বিচিত্র বিষয় ভাবনাতেও নজির রেখেছেন। বহুচর্চিত সমান্তরাল সিনেমা-র বাইরে বাংলার চলচ্চিত্র শিল্পে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তরুণ মজুমদার (Tarun Majumder)। যিনি খুব ভাল করেই বুঝেছিলেন সংস্কৃতিমনা বাঙালির রুচি কোন ধরনের সিনেমায়, অথচ জনরুচির সিনেমা নির্মাণে তিনি যে চলচ্চিত্র জীবনে কোন সমঝোতা করেছেন এমনটাও নয়। তিনি সেলুলয়েডে এনেছেন বাংলার সেরা সাহিত্যিকদের। একে একে উপহার দিয়েছেন ‘একটুকু বাসা’, ‘আলোর পিপাসা’, ‘বালিকা বধূ’, ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’, ‘পলাতক’, ‘ফুলেশ্বরী’-র মতো জনপ্রিয় ছবি। যে সব ছবিতে বাঙালি দর্শকদেখেছেন সমাজের আনাচে কানাচের মানুষদের গল্প।তরুণ মজুমদারের সিনেমার সহজ রসায়ণ ভালো গল্প ও মন ছোঁয়া গান। এই রসায়ণে সংসার সীমান্তে, গণদেবতা তার উল্লেখযোগ্য কাজ। অন্যদিকে ভালোবাসা ভালোবাসা, দাদার কীর্তি, আলো দেখতে দর্শক টিকিট কাউন্টারে ভিড় করেছে।

মফঃস্বলের ছেলে তরুণ মজুমদার (Tarun Majumder) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের ছাত্র হলেও ফিল্মমেকিং-এর ওপর বরাবরই তাঁর তীব্র আকর্ষণ ছিল। তাই, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ হওয়ার পরই সিনেমা দুনিয়ায় পা বাড়িয়েছিলেন। ১৯৫৯ সালে তাঁর প্রথম ছবি মুক্তি পায়, উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেন অভিনীত ‘চাওয়া পাওয়া’ ছবিটি। তবে এই ছবিটির পরিচালনায়‘যাত্রিক’ নামের একটি গোষ্ঠী। যাঁর সদস্য ছিলেন শচীন মুখোপাধ্যায়, দিলীপ মুখোপাধ্যায়ের এবং তরুণ মজুমদার। ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত ‘যাত্রিক’-এর সঙ্গেই ছবি পরিচালনা করেছেন তিনি। তার পর আলাদা ভাবে ছবি করা শুরু করেন। ১৯৬২ সালে যাত্রিকের পরিচালনাতেই ‘কাঁচের স্বর্গ’ মুক্তি পায়। এতে দিলীপ মুখোপাধ্যায় প্রধান চরিত্রে ছিলেন। এই ছবির জন্য প্রথমবার জাতীয় পুরস্কার পান তরুণ মজুমদার। যাত্রীক পরিচালিত শেষ ছবি পলাতক (১৯৬৩)। এর পর নিমন্ত্রণ, সংসার সীমান্তে, ভালবাসা ভালবাসা, আপন আমার আপন, গণদেবতা, দাদার কীর্তি, পরশমণি, বালিকা বধূ, অমর গীতি, পথভোলা, কুহেলি, ঠগিনী, ফুলেশ্বরী, মেঘমুক্তি, আগমন, অমর গীতি, শ্রীমান পৃথ্বীরাজের মতো বহুল প্রশংসিত ছবি পরিচালনা করেছেন তরুণ মজুমদার।

তরুণ মজুমদারের সিনেমার গল্পে একাধিকবার উঠে এসেছে বাল্য বিবাহ।  এক বালিকাকে সামাজিক চাপে পড়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য করা, তারপর সংসার নামক বোঝা তার উপর চাপানোর চেষ্টা, স্বামী এবং স্ত্রীর সংজ্ঞা না বুঝেই সারাজীবনের এক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যাওয়ার এই প্রথার নানা রমকের দিককে তুলে ধরে সামাজিক পরিস্থিতি নিয়েই হয়ত সকলকে শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন তিনি। নাবালক থেকে সাবালকের কোটায় দাঁড়িয়ে থাকা সরল এক মনে কোণার্কের রতিভাস্কর্য দেখে নিমেষে হওয়া প্রতিক্রিয়াকে তুলে ধরার মধ্যে দিয়েই দর্শকমন বুঝে গিয়েছিলেন পরিচালকের অসামান্যতা ঠিক কতটা। বাংলার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দি রূপান্তরণে সেই নদীর চড়ে বসে চিনি আর অমলের গান আর আকাশের চাঁদ, ‘বড়ে আচ্ছে লগতে হ্যায়, ইয়ে ধরতি, ইয়ে নদীয়া, ইয়ে র‍্যায়না অউর?’ আর সেই আকাশবাণীর মত দূর থেকে ভেসে আসা ‘ও মাঝি রে…’ সেই আবহ কি কখনও ভুলতে পারবেন আপামর সিনেপ্রেমীরা?