এক নজরে

আত্মসমর্পণ

By admin

April 09, 2024

হে গোবিন্দ আমার লাজ রক্ষা কর।

হে বৈকুণ্ঠবাসী আমায় রক্ষা কর।

সভা মাঝে বস্ত্রহরণে দ্রৌপদীর সেই আকুতি কি শুনতে পাননি প্রাণনাথ কৃষ্ণ? শুনতে পেয়েছিলেন সব শব্দগুলিই। কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর প্রিয় ভক্ত দ্রৌপদীর লজ্জা রক্ষার জন্য আসেননি। কারণ দ্রৌপদী তখনও সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করেননি। নিজের লজ্জা রক্ষা করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তাই এক হাত দিয়ে নিজে লজ্জা রক্ষা করেছিলেন এবং অন্যহাতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শরণাপন্ন হচ্ছিলেন। তারপর যখন দ্রৌপদী দু’হাত ওপরে করে করে অর্থাৎ সম্পূর্ণভাবে শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করে বললেন, ‘হে মধুসুদন, হে গোবিন্দ আমায় রক্ষা করো’, তখন কৃষ্ণ চোখের পলকে এসে দ্রৌপদীর লজ্জা রক্ষা করেন।

দুরাচারী দুঃশাসন দ্রোপদীর কাপড় টানতে টানতে বিশাল স্তুপ করে ফেললেন বটে কিন্তু কাপড় ফুরালো না। দ্রৌপদী জিজ্ঞাসা করেছিলেন হয়তো, হে প্রাণনাথ তুমি আসতে এত দেরি করলে কেন? কৃষ্ণ স্মিত হেসে উত্তর দিলেন, ‘আরে আমি তো আরও আগে আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমিই তো আসতে দিচ্ছিলে না।’ ‘এ কেমন কথা, আমি তো তোমার আসার জন‌্য আকুলি বিকুলি করে কান্নাকাটি করেছি।’ কৃষ্ণ বললেন, হ্যাঁ, কান্নাকাটি করেছো বটে, কিন্তু তুমি প্রথমে বৃন্দাবনবাসীকে স্মরণ করলে, বৃন্দাবন থেকে হস্তিনাপুর, তারপর ব্রজবাসীকে স্মরণ করে আমায় আরও দূরে সরিয়ে দিলে। পরক্ষণে সব ভরসার জায়গা ছেড়ে যখন আমাকে স্মরণ করলে, দ‌্যাখো আমি এসে হাজির।’ আমার বাবা একটা কথা বলেছিলেন কোনও একটা সময়। সেই কথাটা আমার কাছে বেদবাক‌্য। ‘দশ আঙুল ফাঁকা করে দেওয়াও যায় না, নেওয়াও যায় না’। অর্থাৎ আত্মসমর্পণ। মুখে বলি ভালোবাসার কথা, কিন্তু সব অনুরাগ, অভিমান, দুঃখ, শ্রদ্ধা, ভক্তি জগতের নয় প্রকার রসে উৎপন্ন যত ভাব আছে, তা কি আমরা সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করতে পারি? পারিনি তো। ভেবেছি, এটা বললে হয়তো খারাপ লাগবে, ওটা বললে হয়তো কষ্ট পাবে, সেটা বললে হয়তো নরম জায়গায় আঘাত করে দেওয়া হবে। হাজার ভাবনায় আমরা আত্মসমর্পণ করতে পারি না নিজেদেরই। ফলে সময়ে আমাদের কাপড় যোগাবে কে?

‘আত্মসমর্পণ’ শব্দটি আমি প্রথম কবে শুনেছিলাম তা আজ আমার মনে নেই। কিন্তু উপলব্ধি করছি এই চুল, দাড়ি পাকা বয়সে এসে। জাগছে প্রশ্নও। আত্মসমর্পণ কনসেপ্টটা কী মানবাধিকার লঙ্ঘন করে না? আত্মসমর্পণ বলতে কি একপ্রকার পরাজয় নয়? আমি আমার অসহায় পরিস্থিতি কারও কাছে আত্মসমর্পণ না করে নিজেরটা বুঝে নেওয়ার চেষ্টাটা চালাবো না? সেটা কি আত্মমর্যাদা হানি করবে না? এটাও মনে হয়, যদি আত্মসমর্পণ একটি পরাজয়ের পরে হয় তবে তার সঙ্গে হতাশা ও তিক্ততা যুক্ত হতে বাধ‌্য। কিন্তু ‘লড়াই’ বা তর্ক-বিতর্কের আগে আত্মসমর্পণ করতে পারলে কোনও বিরোধী অনুভূতি জন্মাবে না। হয়তো সেটাই ওই দশ আঙুল জড়ো করে দেওয়া বা নেওয়া। ধরুণ আমি যখন শিশু ছিলাম তখন আমি আমার মায়ের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলাম। তখন অবশ‌্য এই ভারী কথাটি শুনিওনি, বুঝিওনি। আমি কী খাচ্ছি, কী পরছি, কী পড়ছি, কখন ঘুমোতে যাচ্ছি, কখন খেলার মাঠ থেকে ফিরব, কার সঙ্গে মেলামেশা করছি, সবটাই তাঁর কথা মতো করতাম। তা নিয়ে কোনও তিক্ততা অনুভব করিনি তো। আমি কখনওই তাঁর কর্তৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন করিনি বা তার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে অভিযোগ করিনি। উল্টে আমি নিশ্চিন্তে শান্ত ছিলাম। কারণ, আমি জানতাম, তিনি সর্বদা আমার কথাই ভাবছেন। আমার কোনও চিন্তা নেই। এটা ছিল আত্মসমর্পণ!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কৃপণ’ কবিতা ক্লাস ইলেভেনে পড়তে হত আমাদের স্কুলবেলায়। বাকি অনেক কিছু বেমালুম ভুলে গেলেও ওই কবিতাটি এখনও টাটকা আমার কাছে। রাজপথে এক অজানা ভিখারি ‘আমায় কিছু দাও গো’ বলে ভিক্ষা চাইলেন এক ভিক্ষুকের কাছে। ভিক্ষুক নিজেই তো ভিক্ষা করে বেড়ান, কি আর তাঁকে দেবেন! তখন ঝুলি থেকে একটি ছোট্ট কণা দেন তাঁকে। পরে ভিখারি বাসায় এসে দেখলেন যে ছোট্ট কণাটি তিনি দান করেছেন, সেই কণাটিই স্বর্ণময় হয়ে তাঁর ভিক্ষাপাত্রে জ্বলজ্বল রয়েছে। তখন তার উপলব্ধি হয়, সকল শূন্য করে কেন তিনি সর্বস্ব দিতে পারেননি। কিন্তু সর্বস্ব দিতে গেলে তো আগে পোড়াতে হয় নিজের অহংকে। আর প্রেম ছাড়া আর কিছু নেই যাতে অহং পুড়বে। অহংয়ের ভষ্ম হতে প্রস্ফুটিত হয় প্রেমের ফুল। বিশ্বাস হল সেই ফুলের সৌরভ। সমর্পণ হল ঘ্রাণ। বিশ্বাসের সৌরভে সন্দেহ ভয় ও উদ্বেগ যায় উড়ে। সমর্পণের ঘ্রাণে শান্তি, জ্ঞান ও আনন্দে ভরে যায় হৃদয়। কিন্তু হৃদয়ের দিকে তাকানোর ফুরসত কই আমাদের হাতে। আমরা যে প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে বাহির পানে চোখ মেলেছি, কিন্তু একবারও নিজের ভেতরপানে চেয়েও দেখি না। ভাবতে ভুলে গিয়েছি আত্মসমর্পণের কথা।

CREATOR: gd-jpeg v1.0 (using IJG JPEG v80), quality = 82

দ্রৌপদী কৌরব রাজসভায় যতক্ষণ নিজে তাঁর শাড়িটিকে যথাসাধ্য রক্ষার চেষ্টা করেছেন, ততক্ষণই তাঁর শাড়ি খুলে গিয়েছে। যখন অসহায় হয়ে ভগবানের কাছে সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করেছেন, তখনই অনন্ত শাড়ির যোগান চলে এসেছে তাঁর দেহে। কৌরবেরা হাজার চেষ্টা করেও তাঁকে বস্ত্রহীন করতে পারেনি। দ্রৌপদীর মতোই এমন আত্মসমর্পণ আমাদের প্রয়োজন, তবেই ভালোবাসার লোকটি সকল কিছুই বহন করবে। শুধু ছোট্ট একটি শর্ত, তাঁকে অনন্য চিত্তে স্মরণ করতে হবে, ভালবাসতে হবে।