পার্ক স্ট্রিটের কবরস্থানে কতকাল ধরে তিনি ঘুমিয়ে আছেন। তাঁর পাশেই রয়েছেন প্রিয়তমা হেনরিয়েটা। যশোর জেলার কপোতাক্ষ নদের তীরে সাগরদাঁড়ি গ্রামের জমিদার বংশের সন্তান তিনি। টাকা পয়সার কোনো অভাব ছিল না তাঁর। কিন্তু নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দেওয়ার জীবন তিনি তো চাননি! চেয়েছিলেন নিজের শর্তে বাঁচবেন। স্বপ্ন দেখতেন বড় কবি হওয়ার। চাইতেন বিলাস ব্যাসনের জীবন যাপন। কিন্তু শেষ জীবন কাটে শূন্য পকেটে। স্ত্রী তো বিনা চিকিৎসাতেই মারা যান।
বাংলা সাহিত্যের গোড়াতে এক কবি অকৃপণভাবে মধুভাণ্ডার তৈরি করেছিলেন, যার স্বাদ পুরোপুরিভাবে তার স্বজাতি গ্রহণ করতে পারেনি। বরং অবজ্ঞা ও সমালোচনায় ‘জাত-ত্যাগী’ কবিকে ভর্ৎসনা করেছিল। সেই মধুনির্মাতা মধুকবি মারা যাচ্ছেন শুনে আলিপুর হাসপাতালে অনেকের ভিড় দেখা যায়। তার চরম দুরবস্থার খবর শুনেও এতোদিন যারা মুখ ফিরিয়ে রেখেছিল, তারাও এসে হাজির হয়। রক্তের আত্মীয়তা সত্ত্বেও যারা একদিন তাঁকে ত্যাগ করেছিল, তাদের মনেও হয়তো করুণা হয়েছিল; তারাও আসেন।
কিন্তু কবি তখন মারা যাচ্ছেন। হাসপাতালে ছিলেন সাত-আট দিন। কিছু চিকিৎসা ও সেবা-যত্ন পেলেও কবি খুব একটা মানসিক শান্তিতে ছিলেন না। পরিবার সম্পর্কে তার দুশ্চিন্তা এবং হেনরিয়েটার স্বাস্থ্য সম্পর্কে তার উদ্বেগ তাকে বিচলিত করত। ইতিমধ্যে চরম অসুস্থ কবি এক পুরনো কর্মচারীর মাধ্যমে মর্মান্তিক বেদনার খবর পেলেন, স্ত্রী হেনরিয়াটা আর নেই। কপর্দকশূন্য অবস্থায় স্ত্রীর মৃত্যুতে তখন নিজেও মৃত্যু পথযাত্রী। স্ত্রী বিয়োগের ফলে অসহায় কবির সামনে আরেকটি মারাত্মক উদ্বেগের কারণ এসে উপস্থিত হয়: দুই পুত্রের ভবিষ্যৎ চিন্তা। তার পুত্রদের একটির বয়স তখন মাত্র বারো এবং অন্যটির মোটে ছয়।
তিনি ধর্ম, বিধি, শাস্ত্র, প্রথার কোনোটিই মান্য করেননি। ধর্মান্তরিত হলেও ধর্মনিষ্ঠ হননি কখনই। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের প্রতি তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিলো না। এমনকি, অসহায় অবস্থায় নিজের মৃত্যুশয্যায় শুয়ে মৃত-স্ত্রীর করুণ-স্মৃতি আর নাবালক সন্তানদের অন্ধকার-ভবিষ্যতকে সামনে নিয়েও মাইকেল ধর্মের প্রতি আস্থা প্রদর্শন করেন নি। সমস্ত আশা-ভরসাহীন, রোগকাতর, বিষণ্ণ কবি যখন কেবলমাত্র মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করে আছেন, তখনও খ্রিস্ট ধর্ম অনুযায়ী কবি শেষ স্বীকারোক্তি করেন নি। জীবনকে যিনি নিজের ইচ্ছায় যদ্দুর সম্ভব উপভোগ ও অপচয় করেছিলেন, আসন্ন মৃত্যুর কথা ভেবে তিনি আকুল হননি। ধর্মগত বিশ্বাস ও আচরণের এই পরিস্থিতিতে তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া এবং সমাধি নিয়ে গোলযোগ হতে পারে- এই অবস্থায়ও তাঁর নির্ভীক উত্তর ছিলো: “মানুষের তৈরি চার্চের আমি ধার ধারিনে। আমি আমার স্রষ্টার কাছে ফিরে যাচ্ছি। তিনিই আমাকে তাঁর সর্বোত্তম বিশ্রামস্থলে লুকিয়ে রাখবেন। আপনারা যেখানে খুশি আমাকে সমাধিস্থ করতে পারেন; আপনাদের দরজার সামনে অথবা গাছ তলায়। আমার কঙ্কালগুলোর শান্তি কেউ যেন ভঙ্গ না করে। আমার কবরের ওপর যেন গজিয়ে ওঠে সবুজ ঘাস। ”
তার মৃত্যুর পর সত্যি সত্যিই তার শেষকৃত্য নিয়ে প্রচণ্ড সমস্যা দেখা দিলো। যদিও মৃত্যুর শেষ বিদায়ে থাকার কথা ক্ষমা ও প্রার্থনা, মাইকেলকে সেটা থেকেও বঞ্চিত করা হলো। কলকাতার তৎকালীন খ্রিস্টান সমাজ তার দীক্ষার ঘটনা নিয়ে ঠিক তিরিশ বছর আগে একদিন মহা হৈচৈ করলেও, মৃত্যুর পর তাকে মাত্র ছয় ফুট জায়গা ছেড়ে দিতেও রাজি হল না। নবদীক্ষিত খ্রিস্টান মাইকেলের প্রতি খ্রিস্টান সমাজ যে মনোভাব দেখায়, তা দুঃখজনক। দারুণ গ্রীষ্মের সময়ে মাইকেলের মৃত্যু হয়, খ্রিস্টান সমাজের রোষের দরুণ সেদিন রাতেও তাঁর মরদেহ পড়ে থাকে দুর্গন্ধ-ভরা নোংরা মর্গে।অন্যদিকে, মাইকেলের স্বদেশবাসী ও ধর্মগোষ্ঠীর হিন্দু সমাজও তাকে গঙ্গার ঘাটে পোড়াতে আগ্রহী হয় না। সুতরাং ভেপসা গরমের মধ্যে মাইকেলের অসহায় মরদেহ মর্গেই পচতে থাকে।
অবশেষে মাইকেল-মৃতদেহ-সমস্যার সমাধান হয়, মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টার পরে, কবির মৃতদেহ নিয়ে তার ভক্ত এবং বন্ধু-বান্ধবসহ প্রায় হাজার খানেক মানুষ যান লোয়ার সার্কুলার রোডের খ্রিস্টান গোরস্থানে। বহু লোকের মধ্যে ছিল নানা ধর্ম ও বর্ণের মানুষ। তবে একদা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ নিজের গ্রন্থ উৎসর্গ করে কবি যাদের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিখ্যাত করেছিলেন, তাদের কেউ এই ভিড়ের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন অনেক পাদ্রী তাদের ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। চার্চের ব্যুরিয়াল রেজিস্টারে তাঁর নাম পর্যন্ত ওঠানো হয় না। লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে রক্ষিত চার্চের রেজিস্টারে কবিকে এবং তার স্ত্রী হেনরিয়েটাকে সমাধিস্থ করার কোনো তথ্য নেই।
মাইকেল মধুসূদন সমকালে তুলনায় ছিলেন অনেক ক্ষমতাসম্পন্ন ও প্রতিভাবান। জনারণ্যে সবাইকে ছাড়িয়ে তাকে চোখে পড়ার মতো গুণ ও কৃতিত্ব তিনি অর্জন করেছিলেন। বাংলা সাহিত্যকে তিনি একা যতোটা এগিয়ে দিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে তা আর কে পেরেছেন! জীবদ্দশাতেই তিনি কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছিলেন। কিন্তু এসব সত্ত্বেও তিনি কি আপন হতে পেরেছিলেন অথবা তাঁর যোগ্য সম্মান পেয়েছিলেন?