ঘুরে-ট্যুরে

সবুজের ক্যানভাসে দুটো দিন

By admin

July 01, 2020

শীতের বেলা এমনিতেই ছোট। পাহাড়ি এলাকায় যেন আরো খানিকটা বেশিই ছোট ঠেকে। বিকেল পাঁচটা বাজতে না-বাজতেই ঝপ করে নেমে আসে অন্ধকার। নিকষ কালো তার রং।দুপুরের মধ্যেই পৌঁছে গিয়েছিলাম গন্তব্য মানে অহলদাঁড়ায়। লোকমুখে অবশ্য এখন তা পরিচিত হয়ে গিয়েছে আলধারা নামে। জায়গাটা আপার সিতঙ এ। দুদিনের ছোট্ট অবসরে কাছেপিঠে এই বেড়ানোর সঙ্গী সিইএসসি-রই আরো সাতাশ জন সহকর্মী। রাতভর ট্রেন জার্নির ধকল ছিল, পেটে খিদে ছিল, শরীরে ক্লান্তি ছিল। সময়টা নভেম্বরের মাঝামাঝি। অচেনা জায়গা। মা বলতো, নতুন জায়গায় বেশি বেলা করে স্নান করিস না। ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। অহলদাঁড়ায় কটেজে পৌঁছে যখন ঘরগুলো রেডি করে দিচ্ছে মালকিন নিতা চামলিং, ততক্ষনে দুপুরের খাবারের জন্য মাটির চুলায় কাঠের জ্বালে মুরগির মাংস চাপিয়েছে রাজকুমার আর ওর বউ। কাছের এক গ্রামেই বাস ওই দম্পতির। একসময় অবস্থাসম্পন্ন ছিল পরিবারটি। এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে কপাল পুড়েছে। তবুও ছেলেকে পড়ায় শিলিগুড়ির হোস্টেলে রেখে। পেট চালাতে নিজেরা দিনমজুর খাটে। সঙ্গে আনা হয়েছিল গ্রামেরই আরো একটি মেয়েকে। কাটাকুটি, ধোয়াধুয়ি, মশলা বাটা, বাসন মাজার কাজে সাহায্য করছিল সে।

ঠান্ডা জলে স্নান করতেই শরীর আর মন-দুটোই যেন কেমন চনমনে হয়ে উঠলো। সঙ্গে চাগার দিয়ে উঠলো খিদেটা। ততক্ষণে মুরগির মাংসের ঝোলটা ফুটতে শুরু করেছে। দারুন এক গন্ধ ভেসে আসছে বাতাসে।গরম ভাত, ডাল, আলুভাজা, কোয়াশের সব্জি আর মুরগির মাংসের ঝোল সহকারে দুপুরের খাওয়ার পাট চুকলো বেলা তিনটের মধ্যে।লাঞ্চের পর কেউ কেউ সটান বিছানায়। খানিক জিরিয়ে নিয়ে সন্ধাটাকে উপভোগ করার বাসনায়। আমরা করেকজন কটেজের সামনের ছোট খোলা মাঠে বসলাম রোদ্দুরে।পশ্চিমে মুখ করে। দেখলাম, দিনের শেষ আলোর রেখা প্রথমে আমাদের ছেড়ে মাঠের প্রান্তর, তারপর চা বাগান হয়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল পাইনের বনে।আর দেখলাম অন্ধকারটা পাইনের বন ছাড়িয়ে প্রথমে চা বাগান, তারপর মাঠের কিনার হয়ে শেষমেশ জাপটে ধরলো আমাদের। চারদিকে তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। দূর পাহাড়ে জ্বলে উঠেছে সারি সারি আলো। পাহাড় সেজেছে যেন দীপমালায়। নিচের জনপদগুলোতে জ্বলছে টিমটিমে আলো। মনে হচ্ছে যেন জোনাকির মিছিল।

দেখলাম, দিনের শেষ আলোর রেখা প্রথমে আমাদের ছেড়ে মাঠের প্রান্তর, তারপর চা বাগান হয়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল পাইনের বনে।আর দেখলাম অন্ধকারটা পাইনের বন ছাড়িয়ে প্রথমে চা বাগান, তারপর মাঠের কিনার হয়ে শেষমেশ জাপটে ধরলো আমাদের। চারদিকে তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। দূর পাহাড়ে জ্বলে উঠেছে সারি সারি আলো। পাহাড় সেজেছে যেন দীপমালায়। নিচের জনপদগুলোতে জ্বলছে টিমটিমে আলো। মনে হচ্ছে যেন জোনাকির মিছিল।

নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে অহলদাঁড়ার দূরত্ব সাকুল্যে ৫০ কিলোমিটার। সময় লাগে ঘন্টা দুয়েক। শিলিগুড়ি, সেভক রোড, কালিঝোড়া, লাটপাঞ্চর হয়ে অহলদাঁড়া। উচ্চতা খুব বেশি নয়। বড়জোর ৫ হাজার ফুট। যদিও সেটাও একটা পাহাড়ের মাথা। তবে সেখানের মূল আকর্ষণ হলো ৩৬০ ডিগ্রি খোলা ক্যানভাস। সিনকোনা, কমলা লেবু, পাইনের বন, এলাচের খেত আর চায়ের বাগান। যারা সিটঙে বেড়াতে আসেন তারাও সাইড ট্যুরে আসেন অহলদাঁড়া ভিউ পয়েন্ট। সেখান থেকেই দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা, তিনচুলে, তাগদা আর নীচে বয়ে চলা তিস্তা। আকাশ যদি পরিষ্কার থাকে, তবে ভোরে সূর্যোদয় দেখাও এক স্বর্গীয় অনুভূতি। খোলা ক্যানভাসে যখন পুব আকাশে পড়ছে একের পর এক রঙের ছোপ, ক্রমশ বদলে যাচ্ছে ক্যানভাসটা, উত্তর আকাশে যেন সেই রঙের সাথে যোগ্য সঙ্গত করে চলেছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। মুহুর্মুহু বদলাচ্ছে তার রং- হাঁসের ডিমের কুসুম কমলা থেকে রূপালী। সে এক অনবদ্য যুগলবন্দি। শুধুমাত্র সূর্যোদয় কেন, ওই খোলা ক্যানভাসে ধরা পড়ে দিনান্তের সূর্যাস্তের ছবিও। নিরিবিলি, পাহাড়ি সেই প্রান্তরের প্রতিটি মুহূর্তই সেখানে উপভোগ্য। মনে মনেই কল্পনা করছিলাম, পূর্ণিমার জ্যোৎস্না বিছানো রাতটা কতটা মায়াবী হতে পারে এখানে !

পরদিনের ব্রেকফাস্ট গরম গরম পুরি-সব্জি আর ধোঁয়া ওঠা চা। কেউ চাইলে অবশ্য ওরা রুটি-সব্জি, ব্রেড-বাটার-অমলেট কিংবা ম্যাগিও বানিয়ে দেওয়া হয় অর্ডার অনুযায়ী। সকালে ঠিক করলাম আসে পাশের এলাকাটা একটু ঘুরে দেখা যাক। জঙ্গলের পথে মিনিট পনেরো-কুড়ির দূরত্বে রয়েছে নামথিং পোখরি নামে একটা লেক। বেশ বড়। বর্ষায় তা টইটুম্বুর থাকলেও শীতে জল প্রায় থাকেনা বললেই চলে। সেই লেকের ধারের জঙ্গলে নানা ধরণের পাখির নিশ্চিন্ত আশ্রয়। আর রয়েছে শতাব্দী প্রাচীন এক বৌদ্ধ গুমফা। শান্ত পরিবেশে তাও বেশ সম্ভ্রম জাগায়। দুপুরে খাওয়ার পর পর্যন্ত বিকেলে গিয়ে বসলাম কটেজের কাছেই একটা বেঞ্চে। তিনফুট পরেই খাদ। অন্তত হাজার ফুট নিচু। তবে নিজের সঙ্গে কথা বলার জন্য এক দুর্দান্ত জায়গা। ভাবছিলাম শক্তি চট্টোপাধ্যায়-র ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো’ কবিতাটা। ‘ এখন খাদের পাশে রাত্তিরে দাঁড়ালে…’

রাতে ক্যাম্পফায়ার হলো ঝলসানো মুরগি সহ। সঙ্গে প্রাণ খুলে আড্ডা, গল্প আর গলা ছেড়ে গান। নভেম্বরের ঠান্ডাটা সেখানে বেশ উপভোগ্য। ঠান্ডার একটা আমেজ থাকে বটে তবে তা হাড় কাঁপায় না। রাত বাড়লে অবশ্য পারদ নামে। বইতে শুরু করে কনকনে বাতাস। ডিসেম্বরের পর গাছে গাছে পাকতে শুরু করে কমলা লেবু। বছরের সব ঋতুই সেখানে উপভোগ্য। তাই যে কোনো সময়েই যাওয়া যায়। থাকা-খাওয়ার খরচ পরে প্রতিদিন মাথাপিছু গড়ে ১২০০ টাকা।পরদিন ফেরার পালা।আমরা দলে ছিলাম ২৮ জন। এত মানুষের থাকার ব্যবস্থা সেখানে ছিল না। সেখানে রয়েছে চারটি ঘরের ব্যবস্থা,যেখানে চারটি পরিবার থাকতে পারে। আমরা অবশ্য পরিবার নিয়ে যাইনি। সবাই পুরুষ। কাছেই আরো একটি হোম স্টে তে আরো কয়েকটি ঘর ছিল। সেখানেও বেশ ভালো ব্যবস্থা। কিন্তু আমরা ঠিক করলাম, থাকবো একসঙ্গে,খাবো একসাথে, ভালো-মন্দ যাই হোক না কেন ! কথাবার্তা বলে ঠিক হলো, আরো দুটি বড় টেন্ট খাটানো হবে। সঙ্গে পাণ্ডববর্জিত ওই এলাকায় একসঙ্গে এতজনের আয়োজনের জন্য যে তিন জনকে আনা হয়েছিল তাদের জন্যও পড়লো আরো দুটো ছোট তাঁবু।ফেরার পর জায়গাটার একটা ছবি তুলে পোস্ট করেছিল নীতা। বলেছিল, এখন তাঁবুগুলো নেই। জায়গাটা কেমন খালি খালি ঠেকছে। উত্তরে আমরা বললাম, আমরা ছিলাম ক্ষনিকের অতিথি। এখন যেটা আছে, আগেও সেটাই ছিল। ওটাই তোমাদের শান্ত, নিরিবিলি গ্রাম -অহলদাঁড়া। ওটা ওরকমই থাক।