এক নজরে

কেউ বলেন নারীবাদী তাত্ত্বিক কেউ সাহিত্যিক

By admin

January 09, 2023

বিয়ে করবেন না, এমনকি সন্তানের জন্ম দেবেন না- ছোটবেলাতেই এই দুটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ছোটবেলাতেই দেখতেন তাঁর বাবা দুটি সন্তানই কন্যা বলে মাঝে মধ্যেই আক্ষেপ করতেন। আবার ছোটবেলা থেকেই দারুন মেধাবী হওয়ার কারণে তাঁর বাবা সবসময় বলতেন, একজন ছেলের মতোই নাকি তিনি মেধাবী। হয়তো এই সব কারণেই সেই ছোটবেলাতেই বুঝেছিলেন, যে সমাজ লিঙ্গ বৈষম্যেকে লালন-পালন করে সে সমাজে আর যাই হোক বিয়ের মতো সামাজিক বন্ধন মানায় না। 

ফ্রান্সের সোরবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যাঁ পল সার্ত্রের সঙ্গে আলাপ। সার্ত্রের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বের। তবে কেবলমাত্র বন্ধুত্ব নয়,  সার্ত্রের দার্শনিক চিন্তার বিচার বিশ্লেষণের তীক্ষ্ণ সমালোচক হয়ে ওঠেন তিনি। প্রাক প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, সার্ত্রের সঙ্গে ওলগা কোসাকিউয়িজ এবং ওয়ান্ডা কোসাকিউয়িজের জটিল সম্পর্কের ভিত্তিতে তিনি লিখে ফেলেন তাঁর প্রথম উপন্যাস ’সি কেম টু স্টে’। এই উপন্যাসকে সার্ত্রের সঙ্গে তাঁর অপেক্ষাকৃত জটিল সম্পর্কের কথা বলেই মনে করা হয়। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনাগত ভাবিষ্যতের পটভূমিতে লেখেন দ্বিতীয় উপন্যাস ‘লা সেং ডেস অট্রিস’। নায়ক জন ব্লোমার্ট পারিবারিক বাধা নিষেধ উপেক্ষা করে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেওয়ার পর হেলেন নামে এক নারীর প্রেমে পড়েন। শুরু হয় জনের রাজনৈতিক এবং পাশাপাশি ব্যক্তিকেন্দ্রিক বিচার বুদ্ধিবৃত্তিক এক নতুন জীবনের কাহিনী। উপন্যাসটি একটি রাজনৈতিক উপন্যাস হিসেবেও বেশ জনপ্রিয়তা পায়।

এরপর মনোবিজ্ঞানী এনি ডুবরুইল এবং তার স্বামী রোবার্টের জীবনাচরণের কথামালায় লেখেন আত্মজীবনিমূলক উপন্যাস ‘লেস মেন্ডারিন’ বা দি ম্যান্ডারিন। রূপক আর ব্যাঙ্গাত্মকভাবে লেখা ভিন্নধর্মী এই উপন্যাসটিতে তিনি তাঁর ও সার্ত্রের অনেক ঘটনাই তুলে এনেছিলেন। পরপর তিনটি উপন্যাস সাড়া ফেললেও দুই খণ্ডে প্রায় এক হাজার পৃষ্ঠায় লেখা ‘দি সেকেন্ড সেক্স’ তাঁর সবচেয়ে সাড়া জাগানো এবং নারীবাদী গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এই বইটি যে গোটা দুনিয়ায় নারীবাদী তত্ত্ব এবং প্রতিবাদী জোয়ার তৈরি করেছিল তা নিয়ে কারও কোনও আপত্তি নেই। শুধু লিঙ্গ বৈষম্য দিয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ যেভাবে নারী সমাজকে ভাষাহীন, স্বপ্নহীন এবং সামাজিক দুর্বল জীবে পরিণত করে রাখতে সচেষ্ট তা তিনি মনস্তাত্ত্বিক এবং ইতিহাসগত ব্যাখ্যা দিয়ে অত্যন্ত জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন।  

গত শতাব্দীর ষাট দশকের শুরুর দিকে তিনি জরায়ুর স্বাধীনতা, গর্ভপাত এবং নারীর ওপর যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। তিনি প্রচার করেন একজন পুরুষের সামাজিক মর্যাদায় যে অবস্থান থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আছে, একজন নারীরও ঠিক সমানভাবে সেই একই অধিকার আছে। আসলে তিনি নিজের পছন্দমতো জীবনযাপনেই বিশ্বাসী এবং অভ্যস্থ ছিলেন। তিনি নারীর অধিকার নিয়ে  অত্যন্ত সচেতন ছিলেন, তাই লোক দেখানো সামাজিকতায় তাঁর কোনো আস্থা ছিলনা। ফলে পুরুষকেন্দ্রিক আচার আনুষ্ঠানে তিনি খুব কম সময়েই হাজির হতেন। এমনকি ব্যক্তিগত ফটোগ্রাফারের অনুরোধেও একটু মুচকি হাসতে তাঁর আপত্তি থাকতো। 

নিজের শৈশব, বেড়ে ওঠা, চারপাশের ঘটনাবলি, সার্ত্রের সঙ্গে জীবনের নানা ওঠাপড়া, তিক্ত এবং মধুর তর্কবিতর্ক, গল্পগুজব, বিশ্বযুদ্ধের দুর্বিসহ স্মৃতি, বিভিন্ন সময়ে সার্ত্রের সঙ্গে পর্তুগাল, তিউনেসিয়া, সুইজারল্যন্ড, ইটালি, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন ভ্রমণের অভিঙ্গতা, ফিডেল ক্যাস্ট্রো, ক্রশ্চেভ, চে গুয়াভারাসহ প্রমুখ বিপ্লবী নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ ইত্যাদি জায়গা পেয়েছে মেমোয়ার্স অব এ ডিউটিফুল ডটার, দি প্রাইম টাইম, ফোর্স অব সারকামস্টেন্স এবং অল সেইড অল ডান– চার খণ্ডে লেখা তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থগুলিতে। তাঁর প্রথম জীবনে দেখা অনুসরণীয় কিছু প্রগিতিশীল নারীদের গল্প অবলম্বনে লেখেন ছোটগল্প ‘দা থিংস অব দি স্পিরিট কাম ফার্স্ট’। নারী অধিকার নিয়ে আরেক ছোটগল্পের সিরিজ ’দি ওমেন ডেস্ট্রয়েড’, সার্ত্রের জীবনের শেষ বছর গুলোর স্মৃতি নিয়ে লিখেছিলেন ‘এ ফেয়ারওয়েল টু সার্ত্র’

একজন নারী অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া মানেই যে সে পুরুষের মতো স্বাধীন, তা তিনি মনে করতেন না। বরং একজন নারী পুরুষ-সমাজে কতটা মানসিক ভাবে স্বাধীনতা পাচ্ছে সেটাই ছিল তাঁর বিবেচ্য। তাই নারীর স্বাধীনতা  বিষয়টিকে তিনি সামাজিক এবং পুরুষের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থান থেকে দেখতে চেয়েছিলেন। অনেকেই মনে করেন তাঁর দার্শনিক চিন্তায় উজ্জীবিত গ্রন্থ ‘দি এথিক্স অব এমবিগিউটি’ সার্ত্রের ‘বিং এন্ড নাথিং লেস’ দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং প্রভাবিত।   কিন্তু  তিনি খোলাখুলি জানিয়েছিলেন, যে তিনি সার্ত্রের চিন্তা এবং দর্শনে কখনই প্রভাবিত ছিলেন না। তাছাড়া তার কথায় তিনি নিজেকে একজন দার্শনিকের চেয়ে সাহিত্যিক হিসেবেই দেখতে বেশি ভালোবাসেন।