এক নজরে

জ্ঞান নিয়ে বসে থাকো

By admin

March 10, 2024

চোস্ত হিন্দি বলতে পারে। ইংরাজিটাও বেশ ঝরঝরে। এটুকু হলেই আমরা খুশি। ছেলেটি বা মেয়েটি চলনে-বলনে বেশ স্মার্ট! এই ‘চলন’ ‘বলন’ মানে যদি হয় চলা ও বলা, তাহলে ব্যাপারটি কিন্তু অনেকটাই আচার-আচরণের সঙ্গে যুক্ত। বলন ঠিকঠাক ভাবে উতরে দিতে পারলে চলনের খামতি নিয়ে আমরা ভাবিত নই। সেকেলেরা বলতে পারেন, ফটর ফটর ইংরাজিটাই সব নয়, ওটা আসলে আস্ফালন। দামি দামি পোশাক পরলাম, পরিপাটি হয়ে সাজগোজ করলাম, কিন্তু যখনই অন্যের সামনে মুখ খুললাম তখনই কিন্তু টুটে গেল বাইরের স্মার্টনেস। আকছার ঘটছে এসব। না বললেই ভাবনা থাকে না, তবু মিছে মিছে ভাবি। স্টাইলিশ মোড়কের আড়াল ছেড়ে আনস্মার্ট একজনের জন্ম নেওয়া এখন আর বিরল নয়। আসলে কাকে বলে স্মার্টনেস? ইংরেজি অভিধানে স্মার্ট শব্দটির এক অর্থ হচ্ছে উজ্জ্বল, নবীন দর্শন, পরিচ্ছন্ন ও সুবেশধারী। আমার মতো সেকেলে লোকেরা হয়তো বলে বসবে, ধুস ওগুলো সব বিধাতার দান। তোমার স্মার্টনেস তোমার পড়াশোনা, তোমার তিক্ষ্ণ বিশ্লেষণ, তোমার বুদ্ধিমত্তার উপর নির্ভর করে। শিক্ষা তোমাকে এক ধরণের স্থিতধি করবে। আর তখনই তোমার মধ‌্য থেকে এক অদৃশ‌্য আলোক আবেশ ঘটাবে আশপাশে। চটপটে মানে অযথা চঞ্চলতা নয়, নয় অকারণ বাচালতা। এসবের সঙ্গে সঙ্গে স্মার্টনেশের কোনও যোগ নেই। আমি বাড়ি গেলে দেখি। মাথায় ঘোমটা টানা শাড়ি পরা, ফুল হাতা ব্লাউজ, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, হাতে কয়েকটা বই। এই ছবিটা কি আনস্মার্ট? অনেককেই জিজ্ঞেস করে দেখেছি, সবাই বলেছে, না, খুব স্মার্ট। কেন? কারণ, তাঁর চেহারায়, প্রকাশে যে ঝরে পড়ে চিন্তাভাবনার অগ্রসরতা।

কথাগুলো আসলে আমার মনে হয়েছিল বিশেষ পালিত একটি দিনে। ভাষা শহিদ দিবসে। ঠিক ভুল জানি না, সহজপাঠ কি এখন বড়ই জটিল? বর্ণপরিচয়ের সঙ্গে পরিচিত হতে কার খোঁজ পড়ে এখন। ভাষা শহিদ দিবসে দাড়িয়ে লাখ টাকার প্রশ্ন এটাই, বাঙালির শিশুশিক্ষা শুরুর যে হাতিয়ার ছিল ঘরে ঘরে তা কি এখন ‘অপ্রয়োজনীয়’ পুস্তিকার দলে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ‌্যাসাগরকে মাথার উপরে রেখে তাঁদের সহজপাঠ ও বর্ণপরিচয় কি শিকেয় তোলা। অনেকের প্রশ্ন, বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ কী? বাংলা ভাষা কি বিপন্ন নয়? এই মুহূর্তে মনে হয়, বাংলা ভাষা অস্তিত্বের সঙ্কটে না পড়লেও তার ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন আছে। বিপদটা বাড়িয়ে দিয়েছে আমাদের স্মার্ট দেখনদারি। এটা তো ঠিক, সমাজের সাধারণ শ্রেণির ড্রয়িংরুমে বাংলা চর্চা করতে আর চায় না কেউ। একক ভাষা হিসাবে ইংরেজি চর্চা ও ব্যবহারের প্রতি একটা নেশা। তাহলে কি ইংরাজি পড়ব না আমরা? কেন পড়ব না? এটা তো এখন সবচেয়ে বেশি ব‌্যবহৃত কাজের ভাষা। কিন্তু ইংরেজি শিখতে হবে বলে যে মাতৃভাষাকে জলাঞ্জলি দিতে হবে এমন কোনও মানে নেই। বরং মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা যার যত গভীর সে তত সহজে অন্যের ভাষা শিখতে পারবে। এটাই নিয়ম। এটাই বিজ্ঞান।

একাধিক ভাষা শিক্ষার মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। বরং আমাদের বাংলা ভাষার যাঁরা মহান মনীষী ছিলেন তাঁদের প্রত্যেকের একাধিক ভাষায় গভীরতা ছিল। তাই তাঁরা নিজেদের মাতৃভাষার প্রতিও সমান ভালবাসা আর মমত্ববোধ অনুভব করতেন। লীলা মজুমদার তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন, তখন বর্ষা শেষ হয়ে আসছে। উদয়নের সামনের বারান্দায় ক্লাস। মাথার ওপর নীল আকাশ, ছেঁড়া মেঘ। কবি শেলির স্কাইলার্ক পড়াচ্ছেন। মূল কবিতাটি ইংরেজিতে পড়ার পর তা বুঝিয়ে দিচ্ছেন বাংলায়। ‘আর কাউকে এমন কবিতা পড়াতে শুনিনি।’ ইংরেজি রবীন্দ্রনাথের কাছে নিতান্ত কাজের ভাষা হয়ে থাকেনি, তা রবীন্দ্রনাথের মনন ও আবগের ভাষাও হয়ে উঠেছিল। বাংলার তুলনায় সংখ্যায় অনেক কম হলেও ইংরেজিতে মৌলিক নাটক, প্রবন্ধ লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু ট্রেনে, বাসে, রিকশায়, ট্যাক্সিতে, হাটেবাজারে, রাস্তায়-ফুটপাতে, শপিংমলে, হোটেলে নিজেদের স্মার্ট দেখাতে গিয়ে প্রয়োজনের চেয়ে অপ্রয়োজনে যখন ইংরেজি বা হিন্দিতে কথা বলি তার বেলা?

নীরদ চৌধুরী অনেক আগেই লিখেছিলেন ‘আত্মঘাতী বাঙালি’। তিনি ভবিষ্যৎ কীভাবে দেখেছিলেন জানি না, কিন্তু আমরা যে আত্মঘাতী, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ইউনেসকোর মতে, ‘একটি ভাষা তখনই হারিয়ে যায়, যখন সেই ভাষায় কথা বলার লোক হারিয়ে যায় কিংবা তারা অন্য ভাষায় কথা বলতে শুরু করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটি তুলনামূলক শক্তিশালী গোষ্ঠী দ্বারাই বৃহত্তর ভাষা ব্যবহার হয়ে থাকে।’ বাংলা বলে বাংলা নয়, এভাবেই হারিয়ে যাবে অনেকের মাতৃভাষা। অনেক গবেষকই মনে করেন, পৃথিবীতে বর্তমানে ৫ হাজারের চেয়ে কিছু বেশি ভাষা জীবিত রয়েছে। একশো বছর পর ভাষা কমে একেবারে অর্ধেক হয়ে যেতে পারে। যে ভাষাগুলো মরে যাবে, সেই ভাষাভাষী মানুষদের বেশির ভাগই তখন কথা বলবে ইংরেজি, পর্তুগিজ, স্প্যানিশ, চিনা, রুশ, ইন্দোনেশিয়ান, আরব, সুয়াহিলি আর হিন্দি ভাষায়। দেখো আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না— এমন বলতে পারলে যেন তৃপ্তি। বাকিদের কথা বাদই দিলাম, আমরা যারা খবরের কাগজে কাজ করি, বিজ্ঞাপন জগতে কাজ করি, তারাই বা বাংলা ভাষা নিয়ে কতটা যত্নশীল। উল্টে আমাদের মতো লোকেদের মুখেই তো শোনা যায়, যত্তসব। স-শ-ষ কি দরকার ছিল বাপু। হয় ই-কার নয় ঈ-কার রাখলে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত। তাই বিজ্ঞাপনে ইচ্ছাকৃত ভুল বানান, ভুল উচ্চারণ দেখেও আমরা এড়িয়ে যাই। কেননা আমাদের বদ্ধমূল ধারণা জন্মে যাচ্ছে যে, বাংলা বলতে না পারা লোকগুলো তো বেশ চকচকে! আর বাংলায় অভ‌্যস্তরা সেই নাগরিক কবিয়াল হয়ে থেকে গিয়েছে। অথচ দেখুন কবিয়ালকে হতে হয় কবি। কারণ এই গানে গায়ককে কবিত্ব শক্তি প্রকাশ করতে হয় ছন্দ, লয়, তাল ও নিগূঢ় যুক্তি, তথ্য, তত্ত্ব দিয়ে। শব্দের চয়ন, ব্যবহার, বোধগম্যতা ও প্রাঞ্জলতাকে ধরে রাখতে হয়। এই গুণগুলি তো স্মার্টনেসের কোনও উপাদান নয় চলতি সময়ে। ফলে কবিয়ালদের নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। কিন্তু এটাও তো ঠিক আমরা যদি বিস্তৃত জ্ঞানচর্চা করতে চাই, তা কি বাংলা ভাষায় সম্ভব?

বিস্তৃতির কথা ছেড়ে দিন বাংলা সাহিত‌্য বাদ দিলে অন‌্য কোনও ভাষায় ভালো কলেজে অনার্স পড়তে গেলেই তো বাংলা বইয়ের অভাব স্পষ্ট। পশ্চিমের বৃহত্তর জ্ঞানচর্চার কোনও পরিভাষা বাংলা ভাষায় তৈরি না হওয়ার ফলে বাংলা ভাষার উপরে যাঁরা নির্ভর করেন তাঁদের কূপমণ্ডূকতা যেমন ঘোচেনি, তেমনই বাংলা ভাষায় যাঁরা জ্ঞানচর্চা করতে চান তাঁদেরও এক সীমিত পরিসরে কাজ করতে হয়েছে। আমরা বাংলাকে জ্ঞানচর্চার ভাষা গড়ে তুলতে পারিনি এ অক্ষমতা অস্বীকার করি কী করে। কিন্তু তা বলে তো জ্ঞানচর্চা থেমে থাকবে, এমন তো নয়। জ্ঞানচর্চা এগিয়ে চলবে তার নিজের মতো করেই। শুধু বাংলা ভাষা তার সঙ্গে তাল মেলাতে পারবে না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবে। আর সেই সুযোগে হাবে ভাবে ‘স্মার্ট’রা কিন্তু তুড়ি মেরে শিস দিতে দিতে বেরিয়েই যাবে। জ্ঞান, পড়াশোনা, ঐতিহ‌্য নিয়ে বসে থাকো তোমরা বাঙালি।