এক নজরে

শৈলেন্দ্র এক কালজয়ী গীতিকার

By admin

August 31, 2023

দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক বছর পরের ঘটনা। মুম্বাইতে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের অনুষ্ঠানে তরুন কবি শঙ্করদাস কেসরীলাল তাঁর স্বরচিত কবিতা ‘জ্বলতা হ্যায় পঞ্জাব’ পাঠ করছিলেন। মন দিয়ে কবিতাটি শুনছিলেন তাঁরই বয়সী আরেক তরুন। কবিতা পড়া শেষ হতেই কবির সঙ্গে এসে আলাপ করলেন সেই তরুণ। নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, আমি রাজ কাপুর, পৃথ্বীরাজ কাপুরের ছেলে। তখনও পর্যন্ত সেটাই ছিল তাঁর পরিচয়। রাজ কবি শঙ্করদাসকে জানালেন যে তিনি একটি ছবি বানাচ্ছেন; নাম ‘আগ’। তারপরই রাজ সরাসরি শঙ্করদাসকে তাঁর ছবিতে গান লেখার প্রস্তাব দেন এবং এর জন্য তাঁকে ৫০০ টাকা পারিশ্রমিক দেওয়ার কথাও জানান। কিন্তু তরুণ কবি শঙ্করদাস রাজের সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, তিনি এ কাজ করতে পারবেন না, কারণ, তিনি বামপন্থী রাজনৈতিক ভাবাদর্শে বিশ্বাসী, টাকার বিনিময়ে তিনি হিন্দি বানিজ্যিক ছবির জন্য গান লিখে নিজের আদর্শকে বিসর্জন দিতে পারবেন না।

‘বরসাত’ ছবির জন্য দুটি গান লেখার পর শঙ্করদাস কেসরীলাল শৈলেন্দ্র নামেই হিন্দি ছবির গীতিকার হিসাবে পরিচিত হয়ে যান। তারপরও বহুদিন তিনি মনে প্রাণে বাম রাজনীতির ভাবাদর্শে আস্থা রেখেছিলেন। আইপিটিএ-এর সঙ্গেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। বম্বে ইয়ুথ কয়্যারের সঙ্গেও তাঁর যথেষ্ট যোগাযোগ ছিল। আইপিটিএ-তেই সলিল চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় এবং পরবর্তীতে বিমল রায়ের সঙ্গে আলাপ, শচীন দেব বর্মনের সঙ্গে আলাপও বিমল রায় মারফত। সেই সূত্র ধরেই সলিল চৌধুরীর জন্য ‘মধুমতী’, ‘পরখ’ ছবির জন্য গান লেখেন, শচীন দেব বর্মনের জন্য লেখেন ‘বন্দিনী’ ছবির গান, রাহুল দেব বর্মনের প্রথম ছবি ‘ছোটে নবাব’-এর গান লিখেছিলেন শৈলেন্দ্র। কেবলমাত্র তাই নয়, ছবিতে সুর রচনার জন্য পন্ডিত রবিশঙ্করও আস্থা রেখেছিলেন শৈলেন্দ্র-র মতো গীতিকারের ওপর।

রাজ কাপুরের ছবি ‘আওয়ারা’ তে শংকর-জয়কিষাণের সুরে শৈলেন্দ্র-র লেখা ‘আওয়ারা হুঁ’ এবং ‘মেরা জুতা হ্যায় জাপানি’ তো একসময় প্রায় জাতিয় সংগীতের পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। ‘আওয়ারা’ ছবিটি উপমহাদেশের সীমানা পেরিয়ে রাশিয়া, চীনসহ কয়েকটি দেশে যেমন জনপ্রিয় হয়েছিল একই সঙ্গে ওই গান দুটিও। এছাড়া উল্লেখ করার মতো শৈলেন্দ্র-র অসংখ্য গান রয়েছে। ‘ও সজনা বরখা বহার আয়ি’- ‘পরখ’, ‘অবকে বরষ ভেজ ভইয়াকো বাবুল’- ‘বন্দিনী’, ‘অ্যায় মেরে দিল অউর চল’- ‘দাগ’, ‘ধরতি কহে পুকার কে’- ‘দো বিঘা জমিন’, ‘জাগো মোহন প্যারে’- ‘জাগতে রহো’, ‘আজিব দস্তা হ্যায় ইয়ে’- ‘দিল অপনা প্রীত পরায়া’, ‘পুছো না ক্যায়সে ম্যায়নে রৈনে বিতায়ি’- ‘মেরি সুরত তেরি আঁখে’, ‘সজনওয়া বৈরি হো গয়ি হমার’- ‘তিসরি কসম’ এমন অসংখ্য হিন্দি ছবির গানের জন্যই অমর হয়ে আছেন শঙ্করদাস কেসরীলাল ওরফে শৈলেন্দ্র।

খেয়াল করার মতো বিষয় হল শৈলেন্দ্র যেসব ছবির জন্য যেকটি গান লিখেছেন তার ভাষা, ছন্দ, অলংকার এমনকি গানের চলন গড়নও একটির থেকে আরেকটি পুরোপুরি আলাদা। গান লেখার সময়ে তিনি বার বার নিজেকে যেমন ভেঙেছেন একই সঙ্গে ভেঙেছেন তাঁর সমাজ-শ্রেণি এবং স্বকীয়তাকে। যে কারণে তাঁর গানের ভাবনা এবং ভাষার পরিবর্তন ঘটেছে বার বার। ছবির জন্য গান রচনার ক্ষেত্রে তিনি সব সময়েই লক্ষ্য রাখতেন ছবির আখ্যান, প্রেক্ষাপট এবং চরিত্র বিশেষ করে ছবির যে মানুষটি ওই গানে লিপ দিচ্ছে তার ওপর। ছবির মধ্যবিত্ত চরিত্র যখন গান গাইছে তখন তিনি যে ভাষা ব্যবহার করছেন তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ভাষায় লিখছেন কৃষক বা ভিক্ষুকের লিপের গানে। এমনকি ছবির চরিত্র যখন বিহারের মানুষ তখন তিনি হিন্দি ভাষায় মিশিয়েছেন ভোজপুরি, আবার শিক্ষিত এবং উপরতলার মানুষের জন্য ব্যবহার করেছেন উর্দু। 

রাজ কাপুরের ‘মেরা নাম জোকার’ ছবির জন্য শৈলেন্দ্র জীবনের শেষ যে গানটি লেখেন-‘জিনা য়ঁহা মরনা য়ঁহা ইসকে সিবা জানা কঁহা’ সেটিও তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনার একটি। সারা জীবন বানিজ্যিক হিন্দি ছবির জন্য গান লিখলেও অন্য ছবির কথা ভাবতেন। তাই সারা জীবনের সর্বস্ব সঞ্চয় দিয়ে ‘তিসরি কসম’-এর মতো একটি ছবি প্রযোজনা করেছিলেন। ভাল গান, ভাল কথা এমনকি অন্য ছবির তকমা জুটলেও ছবি তৈরির দীর্ঘ সময় ধরে তিক্ততা এবং হতাশা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন  মদ্যপানের পরিমান। নিজের ছবির প্রিমিয়ারেও যান নি, ছবি বানিজ্যিকভাবে অসফল হওয়ায় তার দায়ও একার ঘাড়ে নিয়ে প্রায় আত্মহননের পথেই পা বাড়ান।