এক নজরে

সরস্বতীঃ নদী থেকে দেবী

By admin

January 25, 2023

নদী এবং দেবী- ইতিহাসে সরস্বতীর দুই পরিচয়। সরস্বতী মানে নদী, আবার দেবীও। ঋগ্বেদে সরস্বতী নদীর উল্লেখ আছে আবার দেবীসরস্বতীর কথাও আছে। প্রথমে এই দেবী ছিলেন নদীরূপিণী, আজও যেমন গঙ্গাদেবী। ঋগ্বেদ ভারতে সমাগত আর্যদের আদিগ্রন্থ। আর্যরা এসে প্রথমে উত্তর-পশ্চিম ভারতের যে অঞ্চলে বসতি করেছিলেন, সেটির নাম দিয়েছিলেন তাঁরা ব্রহ্মাবর্ত। দুই নদীর মধ্যবর্তী এই অঞ্চল। নদী দুটির নাম: সরস্বতী এবং দৃষদ্বতী। নদীর তীরে বেদ আবৃত্তি ও গীত হত। তখন লেখার প্রচলন ছিল না, তাই আবৃত্তি এবং গানই বেদচর্চার উপায় ছিল। বেদ মানে বিদ্যা। অথবা বাক। যে নদীর ধারে বেদগান, ক্রমশ সেই নদীর নামে বিদ্যাদেবী আরাধিত হলেন, তাঁর নাম হল সরস্বতী। দৃষদ্বতীও হতে পারত, তা হলে বাগ্দেবীর নামের বানান করা আরও ঝকমারি হত।

সরস্বতীর বাহন হাঁস। একটি যুক্তি এই যে, হাঁস জলমেশানো দুধ থেকে দুধটা আলাদা করে পান করতে পারে। অবিদ্যা থেকে বিদ্যাকে ছেঁকে নেওয়াই তো আসল শিক্ষা, তাই সরস্বতী হংসবাহিনী। কিন্তু কখনও আবার তিনি ময়ূরাসীনা। কী তার অর্থ? ময়ূর অহঙ্কারী, নিজের রূপের মোহে নিজেই আবিষ্ট। তাকে বাহন করে সরস্বতী শিক্ষা দেন: বিদ্যা দদাতি বিনয়ম্।

সরস্বতী এক সময়ে শুধু বিদ্যার দেবী রূপেই পরিচিত ছিলেন না, তিনি ছিলেন জীবনদায়িনী নদীরূপে পরিচিত;  সঙ্গে ছিলেন অন্নদায়িনী, এমনকি শত্রুবিনাশিনী রূপেও পরিচিত! সমাজ বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সরস্বতী হয়ে উঠলেন হিন্দু ধর্মের জ্ঞানদায়িনী দেবী।

শুধু জলযুক্ত বলেই দেবীর নাম সরস্বতী তা নয়, বৈদিক যুগের প্রথমে পুণ্যসলিলা সরস্বতী প্রধান এবং সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয় নদী হিসেবেও গণ্য ছিল। নদী হিসেবে গঙ্গা বা যমুনার প্রাধান্য তখনও স্বীকৃত হয়নি। সরস্বতীর উৎপত্তিস্থল হিমালয় অন্তর্গত সিমুর পর্বতে। চলার পথে তীরে তীরে প্রসিদ্ধ তীর্থক্ষেত্রের সমাহার। এর তীরে অনুষ্ঠিত যজ্ঞের নাম সারস্বত যজ্ঞ, নদীর জলে পিতৃতর্পণ বিহিত ছিল।

তবে নদীরূপা ছাড়াও ঋক্ বেদে সরস্বতীর আরেকটা পরিচয় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। সরস্ শব্দের আদি অর্থ জ্যোতি। সূর্যরশ্মির তিনটি রূপ- ইরা, ভারতী ও সরস্বতীর একত্রিত রূপ হল সরস্বতী। ইনি ত্রিলোকের সর্বত্রব্যাপী সূর্যতেজের স্ত্রীশক্তি। ইনি স্বর্গ-মর্ত্যকে দীপ্তি দ্বারা ব্যাপ্ত করে বিরাজমান। বেদে জ্যোতিরূপা সরস্বতীর উদ্দেশ্যে অনেক শ্লোক উৎসর্গ করা হয়েছে।

দেবী সরস্বতী বৈদিক যুগে আরও অনেক গুণের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ‘বাজিনীবতী’ অর্থাৎ অন্নদায়িনী। সূর্যকরের সাহায্যে জল মেঘরূপে বৃষ্টি হয়ে পৃথিবীতে ঝরে পড়ে। পৃথিবী শস্যশালিনী হয়। এভাবেই দেবী সরস্বতী কৃষি ও পশুবৃদ্ধির সহায়ক হয়ে অন্নদাত্রী হয়ে ওঠেন। ঋষিদের বারবার প্রার্থনা, সরস্বতী যেন তাঁদের ধন দান করেন। নদী সরস্বতীর জলে সিক্ত উর্বর মাটিতে আর্যদের কৃষিভিত্তিক সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল; নদীর জল তাঁদের বাণিজ্যিক সম্পদেও বৈভবশালী করেছিল। তাই দেবী হলেন ধনদাত্রী। পরবর্তী কালেও সরস্বতীর এই গুণের কথা মুছে যায়নি। তন্ত্রশাস্ত্রে দেবীর ধ্যানমন্ত্রে তাঁর কাছে ঐশ্বর্য প্রার্থনা করা হয়েছে।