ঘুরে-ট্যুরে

ভেতো বাঙালির সান্দাকফু ট্রেকিং

By admin

August 12, 2020

ষষ্ঠ পর্ব

রাজা ব্যানার্জি| ছবি: ইন্দ্রনীল গাঙ্গুলি ও রুদ্ররাজ দাষ

সে রাতে কখন ঘুমিয়েছিলাম খেয়াল নেই। সান্দাকফু পৌঁছনোর আনন্দে খানিকটা বেশিই উৎফুল্ল ছিলাম সবাই। তাছাড়া এক ঘরেই থাকার আয়োজন। সেটাও রাতের আড্ডার পক্ষে নিঃসন্দেহে বাড়তি একটি পাওনা। ঘুম ভাঙলো টিমের বাকিদের হাঁকডাকেই। তখন বোধহয় ভোর চারটে। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বিছানাতেই যেন জমে হিম হয়ে যাচ্ছি। তবুও মনে হলো, সান্দাকফু এলাম আর কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয় দেখবো না ! যথাসম্ভব গরম কাপড়ে নিজেদের মুড়ে হাজির হলাম ভিউ পয়েন্টে। বাইরের তাপমাত্রা তখন মাইনাস ১০ ডিগ্রির আশেপাশে। শরীর যেন অবশ হয়ে গিয়েছে সকলেরই। ক্যামেরা, ট্রাইপড- সবই আছে সঙ্গে। কিন্তু প্রবল হাওয়ায় ট্রাইপড দাঁড় করিয়ে রাখাই দুস্কর। আর ক্যামেরার শাটার পুশ করার মতো ক্ষমতাও নেই আমাদের। এতটাই অসাড় ঠেকছে হাত।

ঠিক করলাম, তা হোক। অন্তত চোখে তো দেখি। কিছু ছবি নাহয় মনের ক্যামেরাতেই ধরা থাক। খানিকবাদে অন্ধকারটা যেন খানিক ফিকে হলো। পূর্ব দিগন্তে যেন লাগছে লালের ছোঁয়া। ক্রমে সেটা দাঁড়ালো টকটকে গাঢ় লাল। কাঞ্চনজঙ্ঘা হয়ে গেল রক্তিম। সময় যত গড়ালো সেই লাল ধীরে ধীরে কমলা, হলুদ হতে থাকলো। পাহাড়ের বরফের আস্তরণে সে রঙেরই প্রতিফলন। তারপর সে ধরলো রুপালি সাদা রঙ। নির্বাক হয়ে দুচোখ ভরে দেখতে থাকলাম সেই রঙের খেলা।

ব্রেকফাস্টের পর হোটেলের বিল মিটিয়ে এবার ফেরার পালা। বাকিদের বললাম, তোরা এগো। আমি বিল মিটিয়ে আর ধোতরে থেকে ইস্যু করা ট্রেকার্স পাসগুলো হোটেলের মালকিনের কাছেই জমা দিয়ে আসছি। বাকিরা এগিয়ে গিয়েছে। আমি চলেছি একা। গুনগুন করে একটা সুর ভাঁজতে ভাঁজতে নেমে এসেছি প্রায় হাজার ফুট। পথে ওদের কাউকেই চোখে পড়লো না। দেখতে দেখতে নেমে এসেছি বিকেভঞ্জন থেকে সান্দাকফু ওঠার পথে সেই বেঞ্চটার কাছে। গিয়ে বসলাম সেটায়। দেখলাম, পার্ক গুলো তখনো সেখানেই রাখা। ভাবলাম, যাওয়ার সময় নাহয় কেউ খেয়াল করেনি। ফেরার সময়েও কারো চোখে পড়লো না ! হঠাৎ মনে পড়লো, আরে! এ পথে তো আমাদের ফেরার কথাই নয়। বেরোনোর সময়েও গাইড বলে গিয়েছিল, আমরা ফিরবো অন্যপথে, গুরদুম হয়ে।

এবার কি করা ! সঙ্গে টাকা পয়সা আছে বটে। রাস্তাটাও আসার পথে চিনে নিয়েছি। ভাবলাম, ওরা যে পথে যাচ্ছে যাক। আমি এ পথেই নেমে যাই। পরক্ষণেই ভাবলাম, এটা নিতান্তই এক স্বার্থকেন্দ্রিক ভাবনা। ফোনে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। ওরা তো আমার কথা ভেবেই আকুল হবে নিশ্চয়ই। অগত্যা ফের ধরলাম সান্দাকফুর পথ।সেখান থেকে নামবো নিচে।

আজকের মধ্যেই পৌঁছাতে হবে অন্তত ১৬ কিলোমিটার দূরে গুরদুম। মাঝে দ্বিতীয় কোনো গ্রাম নেই। গাইড আগেই বলেছিলো, নামার সময় কোনো তাড়াহুড়ো নয়। হড়কে গেলেও বড় অঘটন ঘটে যেতে পারে। গুরদুমের পথে বেশ কিছুক্ষণ চলার পর দেখলাম, পথের পাশে একটা গাছের তলায় বসে আছে থাপা। আমায় দেখেই যেন ওর ধড়ে প্রাণ এলো। উদ্বিগ্ন হয়ে বললো, ইতনা দের কিউ হুয়া, সাব ? কোই দিককত তো নেহি হুয়া ! আমি ওকে বললাম গল্পটা। এবার দুজনে আরো খানিকটা এগোনোর পর দেখা মিললো আরো তিনজনের। পাইনের জঙ্গল আর পাহাড়ি পথের ধারে তারাও তখন খানিক বিশ্রামে।

অনেকেরই হয়তো ধারণা, পাহাড়ে চড়াটা যতটা কঠিন, নামাটা বোধহয় সে তুলনায় অনেকটাই সহজ। ব্যাপারটা আদৌ তেমন নয়। প্রথমত নামতে হয় খুব সন্তর্পণে। প্রায় পা টিপে টিপে। ফলে গোটা শরীরের চাপটা গিয়ে পড়ে দুটো থাইয়ের ওপর। আর যে পথে আমরা নামছি সেটায় বাড়তি সমস্যা হলো সান্দাকফু থেকে গুরদুমের পথে কোনো গ্রাম নেই। পায়ে চলা সরু পাহাড়ি পথ, দুপাশে শুধুই জঙ্গল। নামতে হচ্ছে একটানা।

কয়েক কিলোমিটার হাঁটার পরই বুঝলাম, তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ। মনে হচ্ছে যেন, আর এক পা-ও এগনোর সামর্থ্য নেই। সঙ্গী যারা তাদের কারো কাছেই জলের বোতল নেই, আমিও নিই নি সঙ্গে। যে তিনজনের ব্যাগে সেগুলি রয়েছে, তারা আরো এগিয়ে গিয়েছে। নিজেদের নির্বুদ্ধিতাকে দায়ি করে তখন কোনো লাভ নেই। তবে এও এক চরম শিক্ষা। বুঝলাম, সকলের কাছেই অন্তত একখানা করে জলের বোতল থাকা একান্ত প্রয়োজন।ক্লান্তিতে কেউ বসে পড়লো গাছের ছায়ায়। আমি পাথরের গায়ে জমে থাকা ঝুরো বরফগুলোই খেতে থাকলাম প্রবল তেষ্টায়। প্রথমে বাকিদের আপত্তি ছিল। কিন্তু প্রবল তেষ্টায় তারাও শেষমেষ একই পথ নিলো। এদিকে গাইড বলে চলেছে, এখানে বেশিক্ষন বসাটা ঠিক হবে না। এই এলাকাটিতে চিতা বাঘ রযেছে। সে কথা শুনে অভিষেক বলে উঠলো, আসুক চিতা বাঘ। হয় ও আমায় মেরে ফেলবে। নাহয় ওকে মেরে আমি রক্ত খাবো। আমার জল চাই, জল। পথের ধারে ঘাসের একটা উপত্যকা দেখে সেখানেই শুয়ে পড়লাম আমরা।

বেলা দুটো নাগাদ চোখে পড়লো, অনেকটা নিচে টিনের একটা শেড দেখা যাচ্ছে। সেটা কি তা স্পষ্ট বোঝার উপায় নেই। ওটাই কি গুরদুম ? জানা নেই। তবে একটা শেড যখন আছে, নিশ্চয়ই জলও হয়তো মিলবে। বেশ খানিক্ষণ বাদে পৌঁছানো গেলো সেখানে। দেখলাম, রাবারের পাইপের মাধ্যমে জল পৌঁছানোর ব্যবস্থা রয়েছে কলে।সেখানেই জল খেলাম প্রাণভরে। তখনই বুঝলাম, কেন বলা হয় জলের অপর নাম জীবন। আর অল্প এগোলেই গুরদুম গ্রামটা। সে পথে আরো খানিকটা এগিয়েই দেখা মিললো বাকি তিনজনেরও। গ্রামের একটা ঘরের দিকে চোখ পড়লো। দরজা খোলা অথচ ঘরে কেউ নেই। খানিক সংকোচের সঙ্গেই পা রাখলাম সেই ঘরে। খাট, বিছানা সবই আছে। আর আছে বইয়ের সম্ভার। চোখে পড়লো, সেখানে রয়েছে বাংলায় গীতাঞ্জলি ও। খানিকটা অবাকই হলাম।

রাতে থাকার ব্যবস্থা যেখানে হয়েছিল, তার মালকিনই জানালেন, শ্রীখোলার(সিঁড়িখোলা) বাজার থেকে দেশি মুরগি আসছে। দিনভর ওই পরিশ্রমের পর তা শুনে মনে হলো যেন এক পুরস্কার। পরদিন আরও কিছুটা নেমে পৌঁছলাম শ্রীখোলা। গায়ে হাতে পায়ে অসম্ভব ব্যথা। কয়েক কিলোমিটারের পথ মনে হচ্ছিল যেন একশো মাইল লম্বা। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে পাহাড়ি নদী শ্রীখোলা। নদীর নামেই জনপদের নাম। মিষ্টি পাহাড়ি এক গ্রাম। দূষণের লেশ মাত্র নেই। চারিদিকে ডাকছে হরেক রকমের পাখি। শান্ত স্বভাবের গ্রাম্য মানুষেরা যে যার নিজের কাজে ব্যাস্ত। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, দেশি মুরগি তো মিলবেই চাইলে পর্কের ব্যবস্থাও হতে পারে। কোনটা বলা হবে রাতের জন্য? জানতে চাইলাম বাকিদের মত। সমস্বরে উত্তর এলো, দুটোই। সে অনুযায়ীই আয়োজন শুরু করলেন হোম স্টে-র মালকিন। আসার পর থেকেই খেয়াল করেছি, মোটের ওপর হোম স্টে গুলো চালান মহিলারাই। পরদিন ফেরার পালা।

ব্রেকফাস্ট সেরে ওঠার পর গাইড বলল রিম্বিক পর্যন্ত হাঁটতে হবে না। রিম্বিক থেকে শ্রীখোলা অব্দি গাড়ি চলার রাস্তা তৈরি হচ্ছে, ও গাড়িকে ডেকে নিয়েছে। খানিকটা হেঁটেই দেখতে পেলাম পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরির কাজ চলছে, একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে আমাদের জিপ। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম যেন। কিন্তু মনটা খারাপ হয়ে গেল। আজ শ্রীখোলা অব্দি রাস্তা তৈরি হচ্ছে, কাল হয়তো গুরদুম হয়ে সান্দাকফু পর্যন্ত ও হয়ে যাবে। টামলিং এর মত এই পথেও তখন ধোঁয়া ছড়িয়ে ছুটে যাবে ল্যান্ডরোভার। তৈরি হবে হোটেল, হারিয়ে যাবে এই পাহাড়ী নির্জনতা। খারাপ লাগছিল ফিরতে হবে ভেবেও। কি সুন্দর এই গ্রামগুলো আর তার মানুষজন। দিল্লি কলকাতার ব্যস্ত নগরজীবনের ইঁদুরদৌড় থেকে অনেক দূরে। কত প্রতিকূল এদের জীবনযাত্রা, কিন্তু মুখের হাসি কখনো মেলায় না।

তখনও দেখছি ইন্দ্র ছবি তুলে চলেছে। গত কয়েকদিনে ও পদে পদে যা করে এসেছে। এনিয়ে যে ওর সঙ্গে দুই একবার বাদানুবাদও হয়নি, তা নয়। কিন্তু এখন বুঝছি, ইন্দ্র আর রুদ্র যদি ওইই কাজটা না করতো তবে আমাদের ঘটমান অতীতের ছবির কোনো ধারাভাষ্যই হয়তো থাকতো না। টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো একদিন হয়তো বিলীন হয়ে যেত।

আমাদের মধ্যে দুজনের টিকিট ছিল ফ্লাইটে। তাদের বাগডোগরা বিমানবন্দরে নামিয়ে বাকিরা চললাম নিউ জলপাইগুড়ি থেকে রাতের ট্রেন ধরতে। স্টেশন চত্বরে পৌঁছেই হরেক কিসিমের খাবার দেখে মনটা সবারই চনমনে হয়ে উঠলো। কেউ খেলো ভেলপুরি, ফুচকা, তো কেউ ঘুগনি, পাপড়ি চাট কিংবা মোমো। সব শেষে চিকেন বিরিয়ানি খেয়ে সোজা ট্রেনে যে যার বার্থে। কথা বলার মতো শক্তিটুকুও নেই। এক সপ্তাহের ধকলে সবার পায়ের অবস্থাই বেশ খারাপ। সঙ্গে শরীরটাও ছেড়ে দিয়েছে। পরদিন সকালে যখন ঘুম ভাঙলো, ট্রেন তখন বর্ধমান ছাড়ছে। কানে ভেসে আসছে পুরানো একটা সুর, গরম চায়ে, চায়ে।

(শেষ)