চার বছর পর ২০২৮ সালে আবার বসবে ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপের আসর। বাছাই পর্ব উৎরোতে পারলে সেখানে নিশয় খেলবে পর্তুগাল। ইউরোপের সেরা প্রতিযোগিতায় জাতীয় দলের হয়ে এক ঝাঁক তরুণ পর্তুগীজ মাঠ মাতাবে। কিন্তু সেই মাঠে থাকবেন না কেবল একজন, তিনি ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। তাঁকে ক্যামেরা খুঁজবে গ্যালারিতে। সেই মুখ ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর।দর্শকেরা তখন তাকে নিয়ে স্মৃতিকাতর হবে।শুক্রবার (৫ জুলাই) রাতে টাইব্রেকারে ফ্রান্সের কাছে হেরে ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে বিদায় নিয়েছে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর পর্তুগাল। ৫-৩ গোলে হেরেছে পর্তুগাল। এই হারের সঙ্গে সঙ্গে এবারের ইউরোর আসর থেকে পর্তুগালকে বিদায় নিতে হয়েছে।
টুর্নামেন্ট শুরুতেই রোনালদো জানিয়েছিলেন এটাই তার শেষ ইউরো। ২০ বছর আগে ২০০৪ সালে এই ইউরোতে প্রথমবার খেলেছিলেন তিনি। সে সময় তার পাশে ছিলেন পুর্তগালের এক কিংবদন্তী লুই ফিগো। ব্যবহার করতেন ১৭ নম্বর জার্সি। একটা সময় ৭ নম্বর জার্সিটা নিজের করে নেন রোনালদো। আর এই জার্সিটাকেই তিনি নিজের নামের সঙ্গে পরিচিত করে তোলেন। বিশ্বব্যাপী পরিচিত সিআরসেভেন নামে। রোনালদো মানেই গোল। তিনি মাঠে নামবেন আর নামলেই গোল করবেন, ম্যাচ জেতাবেন- এটাই স্বভাবসিদ্ধ বিষয় হয়ে গিয়েছিল। এর ব্যতিক্রম হলে সমর্থকরা কিছুতেই তা মেনে নিতে পারেন না। সমালোচকরা কথার বাণ ছোঁড়ার বিষয় পেয়ে যান। তাতে অবশ্য লাভ রোনালদোর। ভালোবাসা তাঁকে শক্তি যোগায় আর সমালোচনা তাঁকে আরো শক্তিশালী করে তোলে।
পর্তুগালের হয়ে ২১২ ম্যাচে ১৩০ গোল করেছেন রোনালদো। আন্তর্জাতিক ফুটবলে তাঁর বেশি গোল কেউ করতে পারেননি, বেশি ম্যাচও কেউ খেলেনি। চৌদ্দটা গোল করেছেন। আন্তর্জাতিক ফুটবলে সবচেয়ে বেশি গোলের কীর্তি তার। হয়তো এই কীর্তি কেউ কখনো ভাঙ্গতে পারবে না। ইউরোতে গোলের রূপকার আটটিতে। ২০১৬ সালে দেশকে ইউরোর শিরোপা এনে দিয়েছেন। ইউসেবিও, ফিগোরা যে সাফল্য পাননি পেপেকে সঙ্গী করে সেই সাফল্য এনে দিয়েছেন রোনালদো। তবে জার্মানিতে এবার ইউরোয় নিজের হারানো সময় ফিরিয়ে আনতে পারেননি রোনালদো। টাইব্রেকার ছাড়া লক্ষ্যভেদ করতে পারেননি। বড় মাপের আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে এবারই প্রথম গোলহীন থেকেই বিদায় নিলেন রোনালদো। শুধু কি তা–ই, ইউরোয় এক আসরে সর্বোচ্চসংখ্যক শট নিয়েও গোল না পাওয়ার অনাকাঙ্ক্ষিত রেকর্ডে যৌথভাবে ভাগও বসিয়েছেন রোনালদো। ১০টি শট নিয়ে একটি গোলও পাননি। ২০১৬ ইউরো এমন কেটেছিল বেলজিয়ামের মিডফিল্ডার কেভিন ডি ব্রুইনার।
স্লোভেনিয়ার বিপক্ষে পেনাল্টি মিস করার পর বিশ্ব দেখেছে রোনালদোর কান্না। টুর্নামেন্ট থেকে দলের বাদ পড়ার শঙ্কাটা তাকে আবেগপ্রবণ করে তুলেছিল। তার ব্যর্থতা যে এখানে সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। ভবিষ্যতে যখন স্মৃতিচারণ করবেন তখন এই কথা মনে হলেও নিজেকে ক্ষমা করতে পারতেন না। তবে শেষটা তার ভালো হয়েছে বলা যায়। অন্তত ব্যর্থতার পুরোটা নিজেদের কাঁধে চেপে বসেনি। স্লোভেনিয়ার বিপক্ষে টাইব্রেকারে যেমন নিজে প্রথম গোল করে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তেমনি দিয়েছেন ফ্রান্সের বিপক্ষে। কিন্তু সতীর্থরা তাকে যোগ্য সহায়তা দিতে পারেনি। টাইব্রেকারে হেরে যায় তার দল।
পর্তুগালের হয়ে ২০১৬ ইউরোজয়ী রোনালদো এখন ২০২৬ বিশ্বকাপে খেলেন কি না, সেটাই দেখার বিষয়। তখন তাঁর বয়স হবে ৪১ বছর। তবে রোনালদোর ক্যারিয়ারে এটাই যে শেষ ইউরো, তা তিনি আগেই জানিয়ে দিয়েছেন। শেষ ষোলোয় স্লোভেনিয়াকে হারানোর পর রেকর্ড ষষ্ঠবারের মতো ইউরো খেলতে আসা রোনালদো বলেছিলেন এবারই শেষ, ‘কোনো সন্দেহ নেই অবশ্যই এটাই শেষ (ইউরো। তবে আবেগ ছুঁয়ে যাচ্ছে না। ফুটবলের সবকিছুই আমাকে প্রভাবিত করে। খেলাটির প্রতি এখনো আমার যে উৎসাহ, দর্শকের আগ্রহ, পরিবারকে পাওয়া, লোকজনের ভালোবাসা…ব্যাপারটা আসলে ফুটবল–বিশ্ব ছেড়ে যাওয়া নয়। আমার জেতার বা করার জন্য আর কীই-বা বাকি আছে?’
ফ্রান্সের কাছে পর্তুগালের হারের পর রোনালদোর হাত জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন তাঁর দীর্ঘদিনের সতীর্থ পেপে। রোনালদো নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁকে কী বলেছেন, এ প্রশ্নের উত্তরে টিভি চ্যানেল ক্যানাল ১১–কে পেপে বলেছেন, ‘আমি এটা জনসমক্ষে বলব না। তবে আমরা কষ্টটা টের পাচ্ছি। অনেকে যা ভাবছে তার বিপরীত। ম্যাচটি জিততে না পারার হতাশা পোড়াচ্ছে আমাদের। দলে অনেক ভালো প্রতিভা আছে জানার পরও এমন বড় একটি টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিতে হচ্ছে, এ কষ্টই আমাদের পোড়াচ্ছে।’
অসংখ্য স্মৃতি, অসাধারণ একঝাঁক মুহূর্ত, আশ্চর্য সব গোল দিয়ে সাজানো রোনাল্ডোর কেরিয়ার৷ তাঁকে মিস করবে টিম পর্তুগাল। মিস করবে গোটা ফুটবল দুনিয়া। নায়ক বা প্রতিনায়কের তকমার আড়ালে তিনি এক অদ্ভুত জাদুকর। বিদায়, ম্যাজিসিয়ান৷ বিদায়, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো।