তৃতীয় পর্ব
রাজা ব্যানার্জি | ছবি: ইন্দ্রনীল গাঙ্গুলি ও রুদ্ররাজ দাষ
অভ্যস্ত হলে হয়তো গতকালই আমরা পৌঁছে যেতে পারতাম টামলিং। যেমন অনেকেই যান। কিন্তু প্রায় কারোরই অভিজ্ঞতা না-থাকায় ট্রেকিং-এর অ-আ-ক-খ বুঝতে বুঝতেই কেটে গিয়েছিল প্রথম দিনটা। তা নিয়ে অবশ্য আমাদের কোনো আক্ষেপ নেই। কারণ, সবটাই চলতে চলতে শেখা। এখন অবশ্য আমরা খানিকটা ধাতস্থ, প্রত্যয়ীও বটে। ১০ হাজার ফুট যখন উঠে এসেছি, বাকি আরো ২ হাজার ফুটও পেরোতে পারবো আশা করি।
সকাল সকাল বেরিয়ে এগারোটা নাগাদ পৌঁছলাম টামলিং। পাথুরে পাহাড়ি পথ। ওই পাহাড়ের গায়েই ধাপ চাষ করে সব্জি ফলায় স্থানীয়রা। গাইড আগেই বলেছিল, টোংলুতে ব্রেকফাস্ট করে সময় নষ্ট করার দরকার নেই। রোজই তো সকালে নুডলস খাচ্ছেন। আজ ব্রেকফাস্ট সারবো টামলিং এ। ওখানে অনেক ধরনের খাবার মেলে। পৌঁছে দেখলাম সত্যিই অনেক রকম ব্যবস্থাই রয়েছে যা গত দুদিনে মেলেনি। স্যান্ডউইচ, নুডলস, সিঙাড়া এবং আরো অনেক কিছুই। তবে খাবার আগেই মনে পড়লো থাপার সতর্কবার্তা। খুব ভারি খাবার না খাওয়াই ভালো। ভরপেট খেয়ে হাঁটতে অসুবিধা হবে। অগত্যা কেউ ডিম-পাউরুটি, কেউ ব্রেড বাটার-পোচ, কেউবা আবার নুডলস কিংবা পুরি-সব্জিতেই ব্রাঞ্চ (ব্রেকফাস্ট কাম লাঞ্চ) সারলাম। টামলিং তুলনায় বড় একটি জনপদ। অন্তত দেড়-দুশো বাড়ি চোখে পড়লো। মানেভঞ্জন থেকে যারা গাড়িতে সান্দাকফু যান, তারা ওখানেই খাওয়া দাওয়া সারেন। ট্রেকারদেরও অনেকে সেখানেই রাতটা কাটান। স্বভাবতই আয়োজন এবং ব্যবস্থাপনা অনেকটাই উন্নত।
জঙ্গলের পথ ছেড়ে টামলিং-এই আমরা পড়লাম গাড়ি চলার রাস্তায়। গাড়ি চলার রাস্তা মানে অবশ্য কালো পিচ ঢালা কিংবা ম্যাস্টিক অ্যাসফল্ট-এ তৈরি নয়। বোল্ডার বিছানো এবড়ো-খেবড়ো পাহাড়ি পথ। দেখলাম, একটা ল্যান্ডরোভার যাচ্ছে সে পথে। কিছুক্ষন পর আর একটা। তার খানিক বাদে ফের একটা। আর সমুদ্রে প্রবল ঝড়ে নৌকা যেমন মোচার খোলের মতো দোলে, তেমনি দুলছে সেগুলো। সেভাবেই নাচতে নাচতে চলেছে গাড়িগুলো পাথুরে পথে। একবার ভাবার চেষ্টা করলাম তার যাত্রীদের পরিস্থিতি। ঘন্টা সাতেকের পথ। এভাবে নাচতে নাচতে চললে কোমর আর সারা গায়ে কি রকম অসহ্য যন্ত্রনা হতে পারে। শুধু তো তাই নয়, পুরানো ল্যান্ডরোভারের টায়ার কোনো কারণে ফাটলে কিংবা দুর্ঘটনাবশত চালক নিয়ন্ত্রণ হারালে গাড়ি সোজা খাদে। সে কথা ভেবে আমাদের সকলেরই একই উপলব্ধি, ভাগ্যিস আমরা হেঁটে যাচ্ছি, ল্যান্ডরোভারে নয়।
ফের শুরু হলো আমাদের পথচলা। বিকেলের মধ্যে পৌঁছতে হবে জৌবাড়ি। টোংলু থেকে টামলিং ৫০০ ফুট নিচে। সেখান থেকে জৌবাড়ির উচ্চতা আরো ৫০০ ফুট কম। ফলে এদিনের পথটা মোটের ওপর উৎরাইয়ে। টামলিং থেকে সান্দাকফু যাবার পথে পড়বে পাঁচটি পাহাড়ি গ্রাম। জৌবাড়ি, গৌরিবাস, কাইয়াকাট্টা, কালিপোখরি এবং বিকেভঞ্জন। পাঁচটিতেই থাকা, খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। টামলিং-র পর থেকেই কখনো বাংলা, কখনো নেপালের অংশের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে পথ। পাইন, রোডোডেনড্রোনের জঙ্গল অবশ্য সে সীমানা মানে না। নেপাল যাওয়ার জন্য ভারতীয়দের পাসপোর্ট বা ভিসার কোনো ঝক্কি না থাকায় আমাদেরও সমস্যা হলো না। সিঙ্গালীলা জাতীয় উদ্যানের ওই অংশটি বিলুপ্তপ্রায় রেড পান্ডার জন্যও বিখ্যাত। আমরা অবশ্য অনেক কসরত করেও তাদের একটিরও দেখা পাইনি।
বিকেল বিকেল পৌঁছে গেলাম জৌবাড়ি। গ্রামটা নেপালের মধ্যে। থাকার ব্যবস্থাও ভালোই। সঙ্গে বাড়তি পাওনা আলো আর গরম জল। রীতিমতো বিদ্যুতের সাব স্টেশন গড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় সেখানে। কারেন্ট আগের জায়গাগুলোতেও ছিলো বটে। যদিও টিমটিমে আলো। তাও কখন থাকে কখন থাকেনা তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। সেক্ষেত্রে মোম বা হ্যারিকেনই ভরসা।
সন্ধ্যা নেমেছে। বাইরে বইছে কনকনে বাতাস। অথচ সঙ্গে থাকা রামের স্টকও শেষের পথে। ইতিমধ্যেই ভাব জমে গিয়েছে গাইডের সঙ্গেও। ওর কাছেই জানতে চাইলাম, এখন কি উপায়? ও জানালো, রাম ভি মিল সকতা হ্যায়। লেকিন মেহেঙ্গা পড়েগা কিউ কি বহুত দূর সে লানা পরতা। আপ চাহে তো ছাং ট্রাই কর সকতে হো। উহ ঘর ঘর মে মিলতা হ্যায়।বললাম, ছাং হি লাও। ছাং দেশি মদ, তিব্বতি এবং নেপালীদের মধ্যে যা অত্যন্ত জনপ্রিয়। পূর্ব হিমালয়ের গুরুং, তামাং, মগরদের মধ্যেও তা খাওয়ার চল রয়েছে। চেখে দেখলাম, খানিকটা মহুয়ার মতো খেতে। শীতকালে গরম গরম পরিবেশন করা হয় বাঁশের পাত্রে। খেয়ে যেন শরীরটা গরম হয়ে গেল। আলো আর গরম জল তো বিকেলেই মিলেছিলো, ডিনারে মিললো চিকেনও। মুরগির ঝোল-ভাত খেয়ে যে যার বিছানায়।
চলবে…