এক নজরে

রাধার ঘুঙুর

By admin

August 14, 2023

কাঠের পায়ে ঘুঙুর বাঁধা/কাঠের কৃষ্ণ কাঠের রাধা/কোন কাঠে কে ছন্দ রাখেন…। রাধা কী ঘুঙুর বাঁধতেন? তার ঘুঙুরের ওঠানামায় কী কৃষ্ণের হৃদয় কেঁপে কেঁপে উঠত? চারপাশ জঙ্গলে ঘেরা বলে বন। তার মাঝে একটি মন্দির। নাম নিধিবন। বৃন্দাবনে লোককথা চালু আছে, এই যে মন্দিরকে ঘিরে রেখেছে বন, সেই জঙ্গলের সব গাছের শাখাই আনত। গাছের শাখা প্রশাখাগুলি জড়ামড়ি করে আছে আদি অনন্ত কাল ধরেই। শোনা কথা, এই গাছগুলি আসলে নাকি রাধা-কৃষ্ণের লীলাখেলার সঙ্গী। রাধা কৃষ্ণকে কতটা ভালোবাসতেন, সে কথা নতুন করে বলার নেই, কিন্তু রাধারা সখীরা কৃষ্ণকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন। সেই শ্রদ্ধাতেই বোধহয় তারা আনত হয়েই থেকে গিয়েছে। আবার উল্টোটাও হতে পারে, নিজেদের মুহূর্তে রাধা ও কৃষ্ণ যে ধরণের লীলাখেলায় মেতে উঠতেন, তাতে হয়তো সখীদের চোখ তুলে তাকানোর জো নেই। লজ্জায় রাঙা হয়ে তারা নীচের দিকে মুখ করে রয়েছে। কোনওটাই জানি না। আর আমি বৃন্দাবনে যাইনি কোনওদিন। তবে এই গল্পটা শুনেছিলাম এক দিদিমার কাছে। যদিও তিনি আবার কৃষ্ণর চেয়ে কালীকে বেশি মানেন। তিনি আরও বলছিলেন, এমনিতে সারাদিন ঠিকঠাক। কিন্তু বিকেলের পর মন্দিরে পড়ে তালা। সন্ধের পর এই মন্দিরে কারও ঢোকার অনুমতি পর্যন্ত নেই। রাত নামলেই নাকি বদলে যায় মন্দিরের রূপ। মনে করা হয়, স্বয়ং কৃষ্ণ আসেন। আসেন রাই কিশোরী। গোপীনিরাও আসেন সেজেগুজে। শুরু হয় লীলাখেলা। আর তাতে নাকি রাধা পায়ে ঘুঙুর বাঁধেন। শোনা যায় সন্ধের পর বন্ধ মন্দিরের প্রাচীরে কান পাতলে শোনা যায় ঘুঙুরের শব্দ। কানে আসে বাঁশির সুরও। ঘনবাদ্যের অধীনে থাকা পরম্পরাগত শাস্ত্রীয় নৃত্যের একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান যখন রাধার পায়ে ওঠে, কৃষ্ণ কী সাহায‌্য করেন তা বেঁধে দিতে। কারণ, পা থেকেই তো পাপের শুরু। আর সে পা যদি ঘুঙুরে ঢাকা থাকে…।

স্বামী লখিন্দরকে সাপে কাটার পর স্ত্রী বেহুলা তাঁকে বাঁচানোর কী রকম চেষ্টা করেছিলেন, সে তো কারও অজানা নয়। কলার ভেলা ভাসিয়ে সাদা ধবধবে চাদরে মৃত স্বামীর দেহ নিয়ে তাঁকে স্বর্গেও যেতে হয়। নেতাই ধোপানির সঙ্গে যান তিনি। স্বামীকে নবজন্ম দিতে, ফেরাতে স্বর্গের রাজা ইন্দ্রকে সন্তুষ্ট করতে হত তাঁকে। কিন্তু কী ভাবে? ইন্দ্রও যে ঘুঙুরের প্রেমে, নাচের প্রেমে পড়ে আছেন, বেহুলা না গেলে জানাই হয়তো হত না। সেখানে ইন্দ্রকে সন্তুষ্ট করতে রাজসভায় নাচেন। যদিও রূপসী বাংলার কবি সেই নৃত্যরত বেহুলার পায়ে ঘুঙুর দেখেননি। তাঁর ভাবনায় ভাঁটফুল জড়িয়ে দিয়েছিলেন। কবিতায় লিখেছিলেন, বাংলার নদী মাঠ ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো তার কেঁদেছিল পায়…। তবে ঘুঙুর পরা, এবং ছন্দে তালে নৃত‌্যকে অন‌্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছেন আদিবাসীরা। ধামসা-মাদল বাদ্য। তালে তালে নাচছেন একদল নারী। পায়ে ঘুঙুর নয়, নূপুর জড়ানো। খোঁপায় ঝুলছে নানা রঙের ফুল। কণ্ঠ আকাশে তুলে হাত ধরাধরি করে নাচছেন তাঁরা। সমবেত কণ্ঠে ‘আতো গাতি কুরি কোড়া, মায়া জালাং ছাড়া কিদেই, ইনদ ভেদ কান বোঙ্গা দেউড়ে…’। সাঁওতালরা বিশ্বাস করে, নূপুর ও নৃত্য ঈশ্বরের দান। শোনা কথা এ নিয়ে সাঁওতাল সমাজে একটি লোককথাও আছে। একেবারে শুরুর দিকের কথা বললে,  সাঁওতালরা কোনও দেবদেবীর পুজোয় বিশ্বাসী ছিলেন না। ফলে  নৃত্য ও বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারও তাঁদের জানা ছিল না। গল্পটা এরকম। একবার দু’জন সাঁওতাল যুবক গেলেন জঙ্গলে। হতে পারে খাবারের শিকারে। শিকার করতে করতে খেয়াল নেই, কখন অন্ধকার নেমে এসেছে। রাতে পথ হারাবেন। সেই ভয়ে তাঁরা একটি গাছে উঠে বসলেন। সেই রাতে তাঁরা শুনতে পেলেন গান ও নাচের শব্দ। শুনতে পেলেন কোথাও ঘুঙুর বাজছে। তাঁরা সেই শব্দ ধরে এগোতে লাগলেন। তারপর যা দেখলেন, তা ভয় পাওয়ার মতোই। মরেকো, জাহের এরা, মারাংবুরু

ও গোঁসাই—এ তিন দেবতা নানা অঙ্গভঙ্গি করে নাচ করছেন। দেবতা বলে কথা। এক দেবতা বললেন, আশেপাশে মানুষের গন্ধ। তার কথা শুনে দেবতা জাহের এরা নির্দেশ করলেন, “তাদের কোনও ক্ষতি করো না। বরং তাদের এখানেই নিয়ে এস।” যুবক দু’জনকে আনা হল। এবং তাঁরা সারারাত দেবতাদের সঙ্গে নাচলেন। ভোরবেলা তাঁদের হাতে দু’টো ঢোল দিয়ে দেবতাদের নির্দেশ, “তোমরা তোমাদের সমাজে ফিরে গিয়ে সব বলবে। তোমরা এখানে যেমন করলে, তা যেন সবাই শেখে এবং আমাদের সম্মান দেখাতে তার প্রয়োগ করে।” শোনা কথা,  এভাবেই সাঁওতাল সমাজে গান ও নাচ জনপ্রিয় হয় বলে শুনলাম এক সাঁওতাল বন্ধুনীর কাছে।  আর নাচে মনিপুরী আদিবাসিদের খ্যাতি তো সারা বিশ্বেই। তাঁদের বিশ্বাস, পৃথিবী সৃষ্টির মূলেই রয়েছে নৃত্য। দেবতা ও দেবীকে মনিপুরী ভাষায় বলে লাইবংথু ও লাইনুরা। এরা মনে করে দেবতা ও দেবীদের চেষ্টার ফসল এই পৃথিবী। নিটোল  পায়ে রিনিঝিনি পায়েলখানি বাজে, মাদল বাজে সেই সঙ্গেতে শ্যামা মেয়ে নাচে…। গায়ের রং শ্যামা হোক বা ফর্সা হোক, পায়ের একজোড়া নুপূর যেন গায়ের রঙের সৌন্দর্যকেও হার মানায়! সেই নুপূরই পরে প্রয়োজনে হয় ঘুঙুর।  নুপূর কি গোড়া থেকেই অলংকার ছিল? একেবারেই না। উল্টে ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, যখন দাসপ্রথা চালু ছিল, তখন নতুন দাস কেনার সঙ্গে সঙ্গেই তার পায়ে পরিয়ে দেওয়া হত ঘুঙুর লাগানো বেড়ি, যা দাসের প্রতিটি পদক্ষেপে বাজত। কোনও দাস পালিয়ে যেতে চাইলে তার ঘুঙুর দ্রুতলয়ে বেজে উঠত এবং মালিক টের পেয়ে যেত। সময় বদলেছে। বর্তমান সময়ে নূপুর আর বাঁধন নয় বরং ফ্যাশনের অংশ। আর ঘুঙুর হয়ে গেল নাচের অন‌্যতম উপাদান। এই ঘুঙুরের আওয়াজ, বিশেষ করে পায়ে বাঁধার সময় তো ঘুঙুরের যে এলেমেলো, মাতাল আওয়াজ কানে আসে, তাতে আমার ক্লান্তি দূর হয়। কারণ অগ্নিসাক্ষী সিনেমায় ঘুঙুরের শব্দ নানা পাটেকরের কানে যে যন্ত্রণা, যে খারাপ লাগা দিত, সেই অভিজ্ঞতা আমার নেই। ভয় লাগে। কারণ, আমি যাকে ভালোবাসি, তাকে যে ঘুঙুরের ছন্দোবদ্ধ মগ্নতায় ভালোবাসি, আবার তা যদি কোনওদিন ঘৃণায় বদলে যায়, তাহলে ওই সিনেমার মতো ঘুঙুরের আওয়াজ হয়তো আমাকে তাড়িয়ে বেড়াবে একেবারে শ্মশানঘাট পর্যন্ত। কাঠের পায়ে ঘুঙুর বাঁধা/কাঠের কৃষ্ণ কাঠের রাধা/কোন কাঠে কে ছন্দ রাখেন…।