%%sitename%%

না-বলা কথা

মা, তোদের ভাত কাপড়ের অভাব হবে না

By admin

August 11, 2020

“আমাদের না বলা বানীর ঘন যামিনীর মাঝে” – কত কি যে জমা হয়ে থাকে বছরের পর বছর। কালক্রমে সেই পূর্ব স্মৃতি জেগে ওঠে সে তার নীরব দুয়ার খুলে প্রাণের পরশ দিয়ে যায় আমাদের কাজে। বিস্তৃত দিনের কথা জেগে ওঠে, কথা বলে ওঠে অনাদি অতীত, মনের শাখা – প্রশাখায় জেগে ওঠে নতুন পাতা, নতুন ফুল – রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছেন “ অদৃশ্য চিত্রকরের স্বহস্তের রচনা”। পুরাতন সঞ্চয় সে তো চিরকালের মতো হারায় না, বর্তমানের উপলখণ্ডে ধাক্কা খেয়ে অতীত তার রুদ্ধতা ছেড়ে দীপ্তি দিতে থাকে পাথেয় হিসাবে। এ হলো নৈরাশ্যের পরিবর্তে আলোকায়ণের পাথেয়।

আমরা মা – বাবার সঙ্গে কলকাতার বেহালার ভাড়াবাড়ির পাট চুকিয়ে বোলপুরে এলাম ১৯৬২ সালে। প্রথম এসে উঠলাম স্কুলবাগানে আমার মায়ের মামার বাড়িতে। তাঁদের আন্তরিকতা আর আতিথেয়তায় প্রায় দিন পনেরো মহানন্দে কাটালাম। আমার মামারাও তখন তাদের এই মামার বাড়িতেই থাকতেন। তারপর একটি ভাড়াবাড়ির সন্ধান পাওয়া গেল বোলপুর চৌরাস্তার কাছে শ্রীনিকেতন রোডে – গুরুজী ভবন। সাংসারিক জিনিসপত্র নিয়ে ঐ বাড়িতে আমরা এসে উঠলাম। অনেকটা বারো ঘর এক উঠোনের মতো বাড়ি। উঠোনটি ছিল বড় প্রশস্ত। চার – পাঁচ ঘর ভাড়াটে। প্রত্যেকের মধ্যে ছিল একটি পারিবারিক ও সখ্যতার বন্ধন। আমি তিন বোনের একমাত্র দাদা। আর ছোট বোন থাকতো বেহালায় কাকাদের কাছে।

এই বাড়িতে বেশ অনেকদিন আমাদের দারিদ্র্যের মধ্যে দিন কেটেছে। বলতে গেলে কোনো – কোনোদিন অর্ধাহারে অনাহারেও দিন কাটাতাম। তবে তার মধ্যে কখনো মনের মধ্যে আনন্দের ঘাটতি ছিল না। আমাদের প্রয়াত পিতা পবিত্ররঞ্জন ঘোষের পৈতৃক ভিটে ছিল বরিশালের কাশীপুরে, চারণকবি মুকুন্দ দাসের কালীবাড়ি ও তদানীন্তন ব্রজমোহন কলেজের কাছেই। বাবা স্বদেশী করতেন। বরিশালের গান্ধী’ প্রবাদ প্রতিম সতীন সেনের মানসপুত্রের মতো ছিলেন আমার বাবা। আমার মা প্রয়াত মলিনা ঘোষ নথুল্লাবাদের এক সংস্কৃতিসম্পন্ন বর্ধিষ্ণু পরিবারের কন্যা। দেশভাগের পর তাঁরা সবাই এপার বাংলায় চলে আসেন। ফেলে আসেন পিতৃপিতামহের পরশধন্য জন্মভিটে।

বোলপুরের বাড়িতে দারিদ্র্যের মধ্যে থেকে মামাদের কাছ থেকে যে অপরিসীম সাহায্য ও কাকাদের থেকে যে আন্তরিক সহযোগিতা পেয়েছি তা আমৃত্যু মনে থাকবে। আমার মা ছিলেন অসীম ধৈর্য্যশালিনী, এর মধ্যেও তিনি দারিদ্র্যকে আড়াল করে রাখতেন – নিজের রুচি ও পরিচ্ছন্নতাকে বজায় রেখে। মাঝে – মধ্যেই যেদিন খাবার জোগাড় হতো না সেদিনও মা স্নান – পূজা সেরে উনুনে একটু কয়লা ও ঘুঁটে দিয়ে আগুন জ্বালাতেন। পাছে পাশের ভাড়াটেরা অরন্ধন টের না পায়। এমনি আর একটি ঘটনা আজও আমার মনের মধ্যে গেঁথে আছে। সেদিন মায়ের কাছে মাত্র একটি টাকা আছে। নিয়মিত মুড়ি বিক্রেতা মুড়ি নিয়ে বাড়িতে এসেছে। মা বলেন তাকে – তুমি আজ মুড়ি দিয়ে যাও – দামটা আজ দিতে পারবো না, পরের দিন দেবো। অতি পরিচিত মুড়ি বিক্রেতা নাছোড়বান্দা – সে টাকা ছাড়া মুড়ি দিতে পারবে না। বাধ্য হয়ে মা তার কাছে সহজ স্বীকারোক্তি করেন – আমার ঘরে মাত্র একটি টাকাই আছে। এটি দিলে আমি কপর্দকশূন্য হয়ে যাবো। মা বাধ্য হয়ে আমাদের কথা ভেবে মুড়িটা এক টাকা দিয়েই নিলেন।

তার বেশ কয়েক বছর পর আমার ছোট বোনের বাড়িতে ছোট ভাগ্নে টাবু সেই মুড়ি বিক্রেতাকে নিয়ে আসে এবং বলে – মামুই তুমি একে চিনতে পারছো? আমি বললাম খুবই। সে আমাকে হাতজোড় করে কাঁচুমাচু মুখে বললো – মাসীমার সঙ্গে সেদিন যে ব্যবহার করেছিলাম তার জন্য আমি সারাজীবন অনুতপ্ত। আমি সে কথায় না গিয়ে তাকে কিছু টাকা দিলাম তার অবস্থার কথা ভেবে। বড় ভাগ্নে বাবু বললো, মামুই তোমার সব মনে পড়লো?এসব কথা এতদিন মনের মধ্যে জমা হয়েছিল।

আর একটি ঘটনা যা আজও আমার মনকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। সেটা ‘৭০ সালের মাঝামাঝি। বিশ্বভারতীর কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের চাকরির নিয়োগপত্র সেদিনই হাতে এসেছে। সেই নিয়োগের কাগজ নিয়ে মা ছুটলেন স্থানীয় নটকোনার (মুদিখানা) দোকানে। ওই নিয়োগপত্র দেখিয়ে আমাদের একমাসের সংসারের মালপত্র মা চাইলেন দোকানদারের কাছে।জানালেন, মাস পেরোলেই ছেলে বেতন পাবে। তখনই মিটিয়ে দেবো ধার। রাজি হয়ে সেই ব্যাবসায়ীও। দিয়ে দিলেন সব মালপত্র। বহু দিন পর বাড়িতে সংসারের এত জিনিস এলো শুধু নিয়োগপত্র পাওয়ার পরেই। সে স্মৃতিও ভুলতে পারি না।

আমার কর্মস্থল বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার থেকে কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরেছি। বাইরের দরজায় দেখি একজন ফকির দাঁড়িয়ে আছেন। আগেই মা বেরিয়ে এসেছেন – সেইসঙ্গে আমার তিন বোন। দেখে ফকির বললেন দু – তিনদিন অভুক্ত তিনি। বোনেদের দেখিয়ে বললেন – মা, তোর এই তিনটি মেয়ের মতো আমারও তিনটি মেয়ে আছে। লজ্জা নিবারণের জন্য তাঁদের কাপড়টুকু নেই। মা ফকিরকে ঘরে ডেকে এনে অতি যত্নে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করলেন – তার চোখেমুখে গভীর তৃপ্তি দেখতে পেয়েছিলাম সেদিন। এরপর মা ঘরে গিয়ে আলমারি থেকে তিনটি নতুন শাড়ির সঙ্গে আরও গোটা তিনেক শাড়ি প্যাকেটে করে ফকিরের হাতে তুলে দেন। আর আমি কিছু নগদ টাকা তাঁকে দিয়েছিলাম। দীর্ঘদেহী ফকিরবাবার চোখে জল। আবেগ জড়ানো কণ্ঠে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে মাকে বলেন – “মা, আমি একজন হত দরিদ্র ফকির। আজ একটা কথা বলে যাচ্ছি, আগামী দিনে তোদের আর ভাতকাপড়ের অভাব হবে না”।

তাঁর সেই আশীর্বাদ আমরা আজও বহন করে চলেছি।