একই সময়ে তাঁরা দুজনেই ছিলেন মহাপুরুষ। কিন্তু তাহলেও তাঁদের সরাসরি সাক্ষাৎ হয়েছে হাতেগুনে এক থেকে দু’বার। রামকৃষ্ণ রবীন্দ্রনাথকে চিনেছিলেন মূলত তাঁর গানে। প্রিয় শিষ্য নরেন্দ্রনাথের (স্বামী বিবেকানন্দ) কণ্ঠে বেশ কয়েকটি রবীন্দ্রসংগীত শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন রামকৃষ্ণ। নরেন্দ্রনাথ নিজে ছিলেন একজন উচ্চমানের ধ্রুপদি, তাই রবীন্দ্রনাথের ধ্রুপদ আঙ্গিকের কিছু গান তিনি প্রায়শই নিজের কণ্ঠে গাইতে পছন্দ করতেন। নরেন্দ্রনাথের কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের যে গানগুলি রামকৃষ্ণ শুনতেন সেগুলি হল, ‘গগনের থালে রবিচন্দ্র-দীপক জ্বলে’, ‘দিবানিশি করিয়া যতন, ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা’, ‘আমার মাথা নত করে দাও’ ইত্যাদি। জানা যায়, রামকৃষ্ণ জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির কয়েকটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সেখানে রামকৃষ্ণের দেখা হয়েছিল। অনেকেই বলেন, রামকৃষ্ণের সঙ্গে ব্রাহ্মসমাজের যোগাযোগ ছিল। ব্রাহ্মসমাজের অনেকেই তাঁকে দেখতে আসতেন, তিনিও যেতেন। ব্রাহ্মসমাজের বেশ কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে রামকৃষ্ণের আলাপ হয়েছিল, যার মধ্যে অন্যতম রবীন্দ্রনাথের পিতৃদেব দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর সঙ্গে রামকৃষ্ণের প্রথমদেখা হয়েছিল ১৮৬৬ সালে, তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স মাত্র ৫ বছর।
দক্ষিণেশ্বরে রামকৃষ্ণ একবার তাঁর দর্শনার্থীদের দেবেন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলেছিলেন, দেবেন্দ্রনাথ তাঁর জীবনে যোগ ও ভোগ দুইকেই একত্র করেছিলেন। রামকৃষ্ণ দেবেন্দ্রনাথকে কলিযুগের জনক রাজার সঙ্গে তুলনা করে সম্মান দেখিয়েছিলেন। ‘কথামৃত’ থেকে জানা যায় যে রামকৃষ্ণ অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিদের সঙ্গে নিজে গিয়েই আলাপ করতেন। তবে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে রামকৃষ্ণের যে আলাপটি বিশেষভাবে আলোচিত সেই দিনটি হল ১৮৮৩ সালের ২ মে। বলা হয়, রামকৃষ্ণের এই দিন সরাসরি বসে রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে গান শুনেছিলেন। উত্তর কলকাতার কাশীশ্বর মিত্রের বাড়িতে সেদিন ছিল নন্দনবাগান ব্রাহ্মসমাজের বিংশ সাংবাৎসরিক উৎসব অনুষ্ঠান। অনেক জ্ঞানীগুণীর সঙ্গে সেখানে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন ২২ বছরের যুবক রবীন্দ্রনাথ এবং সবার ঐকান্তিকভাবে প্রার্থিত পুরুষ রামকৃষ্ণদেব। বাড়ির সব থেকে বড় ঘরে সভার আয়োজন করা হয়েছিল। প্রার্থনাসভার শুরুতে রামকৃষ্ণের শিশুসুলভ অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ পিয়ানো বাজিয়ে গান শুনিয়েছিলেন। সেই গানটি ছিল যুবক রবীন্দ্রনাথের লেখা ব্রহ্মসংগীত, ‘আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে’। নিবিষ্ট মনে সেই গান শুনতে শুনতে রামকৃষ্ণ ভাবোন্মাদ হয়েছিলেন। সেই সভায় উপস্থিত সবাই পরম বিস্ময়ে এক অতীন্দ্রিয় মুহূর্তের সাক্ষী হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং শ্রদ্ধায় বিমোহিত হয়েছিলেন। তারপর ধীরে ধীরে ওই অবস্থা কাটিয়ে উঠে রামকৃষ্ণ সেদিন সবার সঙ্গে লুচি, ডাল, তরকারি, মিষ্টি খেয়ে উপস্থিত সবাইকে, বিশেষ করে যুবক রবীন্দ্রনাথকে বিদায় জানিয়ে দক্ষিণেশ্বরে ফিরে যান।
তিন দিন পরে তৎকালীন ইংরেজি দৈনিক সংবাদপত্র‘দ্য স্টেটসম্যান’ ওই উৎসবের যে খবর করেছিল, তার শেষ লাইনটি ছিল, ‘The choir was led by baboo Rabindra Nath Tagore’। এই চাক্ষুষ দর্শনের প্রায় পঞ্চাশ বছর পর, ত্রিষ্টুপ মুখোপাধ্যায়কে একটি চিঠিতে এই দেখার ঘটনাটি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘পরমহংসদেবকে একদিন দশ মিনিটের জন্য দূর থেকে দেখেচি।’ উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ব্রহ্মবাদী, নিরাকার ব্রহ্মের উপাসক। আর রামকৃষ্ণ সর্বধর্মে অবগাহন করে হয়েছিলেন এক ঋদ্ধ বিনম্রতার প্রতীক এবং সাকার বিশ্বাসী। ১৯৩৩ সালে ত্রিষ্টুপ মুখোপাধ্যায়কে লেখা একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘শ্রদ্ধেয়’ রামকৃষ্ণ সম্পর্কে কিছু লেখার বিষয়ে নিজের অপারগতার কথা জানালেও ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত ‘মালঞ্চ’ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ রামকৃষ্ণ প্রসঙ্গ এনেছিলেন। উপন্যাসের নীরজা রামকৃষ্ণের ভক্ত। বিছানায় মাথার ওপরে টাঙানো তাঁর ছবি। দিনরাত তাঁর কাছেই নীরজা আশ্রয় খোঁজে। দেবর রমেনের সঙ্গে আলাপের সময়ে নীরজা বলে, ‘যখন চোখের জল ভেতরে ভেতরে বুক ভেসে যায়, তখন ওই পরমহংসদেবের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকি’। সব হারানোর যন্ত্রণায় একসময় নীরজা দুহাত জোড় করে রামকৃষ্ণের ছবির দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, ‘বল দাও ঠাকুর, বল দাও, মুক্তি দাও অধম নারীকে। আমার দুঃখ আমার ভগবানকে ঠেকিয়ে রেখেছে, পূজা অর্চনা সব গেল আমার।’ রামকৃষ্ণ প্রসঙ্গে এখানে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক রবীন্দ্রনাথকে আমরা পাই।
‘মালঞ্চ’ উপন্যাসের পর রামকৃষ্ণের প্রতি সুগভীর শ্রদ্ধা ও অনুরাগবশত ১৯৩৬ সালে তাঁর জন্মশতবার্ষিকীতে শান্তিনিকেতনে বসে ‘পরমহংস রামকৃষ্ণদেব’ নামে ১২ লাইনের একটি কবিতাও রচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ‘বহু সাধকের,/ বহু সাধনার ধারা,/ ধেয়ানে তোমার/ মিলিত হয়েছে তারা।/ তোমার জীবনে/ অসীমের লীলা পথে,/ নতুন তীর্থ/ রূপ নিল এ জগতে।/ দেশ বিদেশের/ প্রণাম আনিলে টানি/ সেথায় আমার/ প্রণতি দিলাম আমি।’রবীন্দ্রনাথ এই কবিতাটির একটি ইংরেজি অনুবাদও করেছিলেন। ‘Diverse courses of worship/ from varied springs of fulfillment/ have mingled in your meditation./ The manifold revelation of the joy of the Infinite/ has given form to a shrine of unity in your life/ where from far and near arrive salutations/ to which I join my own.’
প্রসঙ্গত, ১৯৩৭ সালের ১ মার্চ থেকে কলকাতায় রামকৃষ্ণের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে আট দিনের এক বিরাট ধর্ম মহাসভা হয়েছিল। ৩ মার্চ কলকাতা ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে আয়োজিত অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সভাপতি হিসেবে ইংরেজিতে তিনি ভাষণ দিয়েছিলেন। পরদিন ৪ মার্চ আনন্দবাজার পত্রিকায় পুরো ভাষণটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘… ঈশ্বর নিয়ে যে ধারণা দেয়, ঈশ্বর নিয়ে আমার তেমন ধারণা নেই, কাজেই ধার্মিক বলতে সচরাচর যা বোঝায় সেই হিসাবে আমি ধার্মিক পদবাচ্য কি-না তাতে আমার সন্দেহ আছে, সুতরাং আমি যখন এই বিদ্বজ্জন সংসদে বক্তৃতার জন্য অনুরুদ্ধ হই তখন স্বভাবতই আমি ইতস্তত করেছিলাম। কিন্তু যে মহাত্মার স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই মহাসম্মেলনের আয়োজন তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধাবশতঃ আমি এই অনুরোধ রক্ষা করতে সম্মত হই।…’