এক নজরে

পুলিশের বেদম প্রহার ও সমাজ-ইতিহাস-চেতনা

By admin

February 04, 2024

তাঁর দাদা শেখর গঙ্গোপাধ্যায়ের জবানি থেকে জানা যায়, বৈপ্লবিক কার্যকলাপের প্রতি  তাঁর ভাইয়ের তীব্র আকর্ষণ ছিল ছোটবেলা থেকেই। ছাত্রাবস্থাতেই দাদার মতো তিনিও ‘যুগান্তর’ বিপ্লবী দলের সদস্য হয়েছিলেন এবং ছোটবেলা থেকেই তিনি দলের হয়ে অনেক বিপজ্জনক কাজ করতেন, যেমন— অস্ত্র লুকিয়ে রাখা বা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সেই অস্ত্র পৌঁছে দেওয়া, চিঠিপত্র বা বেআইনি বই পৌঁছে দেওয়া এবং আরও অনেক কিছু, যা ব্রিটিস সরকারের আইন অনুসারে সম্পূর্ণ বেআইনি। যে কারণে তাঁর ওপর পুলিশের তীক্ষ্ণ নজর ছিল।

আশ্চর্যের বিষয় হল, তাঁর বাবা প্রমথনাথ কিন্তু ছিলেন একজন পুলিশকর্তা। তিনি  জানতেন তাঁর ছেলে শেখরনাথ স্বাধীনতা সংগ্রামে জড়িয়ে আছেন। বাড়িতে নিষিদ্ধ বইপত্র আসছে।ছোটছেলেটি কি করছেন সবই জানতেন তিনি। কিন্তু সব জেনে বুঝেও তিনি কখনও বাধা সৃষ্টি করেননি।এমনকি বাজেয়াপ্ত বইয়ের ক্ষেত্রেও নয়। পুলিশকর্তা প্রমথনাথ সত্যি এক আশ্চর্য মানুষ ছিলেন। তাঁর বাড়িতে ছিল একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি, বাংলার সমস্ত সাপ্তাহিক-মাসিক পত্রিকা নিয়মিত আসত বাড়িতে।

একদিন সকালবেলায় আচমকা প্রমথনাথের বাড়ি ঘিরে ফেলল পুলিশ। “বাঘের ঘরে যোগের বাসা”- খোদ পুলিশের বাড়িতেই নিষিদ্ধ বইয়ের গন্ধ পেল পুলিশ। ঘটনা তো সত্যি। কিন্তু অন্যান্য ভাই-বোনেদের বুদ্ধিতে সেদিন পুলিশকে অবশ্য খালি হাতেই ফিরতে হয়েছিল। তবু, শেখরনাথের ছোট ভাইকে নিয়ে যাওয়া হল থানায়। রোদে দাঁড় করিয়ে রেখে তাকে দেওয়া হল বেদম প্রহার। প্রমথনাথ তখন থানার ঘরেই বসেছিলেন পিছনে মুখ করে। একটা কথাও বলেননি সেদিন। তার ছেলেকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য কোনো অনুরোধও করেননি। মার খেয়ে জ্বর চলে এসেছিল, কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ফিরেছিলেন। থানা থেকে ফেরার পরে প্রমথনাথের মা তীব্র ভর্ৎসনা করলে মুখে শুধু বলেছিলেন, “অন্যের ছেলেদের যখন এমনি করে থানায় এনে পেটাই; তখন?—” প্রিয়নাথের এই ছোটছেলেটির নাম তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় পরবর্তীতে তিনি নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়।বাংলা কথাসাহিত্যের তিনি অনন্য ও বিশিষ্ট লেখক। প্রতিভাসম্পন্ন ও প্রজ্ঞাদীপ্তও বটে।

জীবনদর্শনের নতুন অভিপ্রায় চিহ্নিত ছিল তাঁর লেখায়। নতুন অর্থে, নতুন প্রত্যয়ে ইতিহাস, রাজনীতি, আর্থ-সমাজ আখ্যানবদ্ধ হয়েছে তাঁর উপন্যাস এবং ছোটগল্পে। তিনি সমসাময়িকদের থেকে অনেকটাই আলাদা, তা নিছক গল্প লেখার জন্য নয়, অনুরুদ্ধ দায়বদ্ধতার কারণে তিনি পুরনো সংঘবদ্ধ জীবনেতিহাস প্রণয়ন করেছেন। তাঁর আখ্যান দ্বন্দ্বময়, ইতিহাসের চরিত্রের ভেতর দিয়ে তিনি তার গল্প-উপন্যাসের কাঠামোয় রক্তমাংস জুড়ে দিয়েছেন, তাতে সঞ্চারিত হয়েছে প্রাণ, চরিত্রগুলি হয়ে উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ।

প্রতিনিধিত্বকারী উপন্যাস ‘উপনিবেশ’। তিন খণ্ডে (অবিভক্ত বঙ্গদেশের বার্মিজ সীমান্তের প্রমত্ত মেঘনার চরইসমাইল-এ বিচিত্র প্রবণতায় ও বৈচিত্র্যময় চরিত্রের সমাবেশ- হিন্দু-মুসলিম, সরকারি কর্মচারী, বার্মিজ-পর্তুগিজ… ১ম খণ্ডে ভূমিকা-সমেত ‘মৃত্তিকা’ও ‘ফসল’, ২য় খণ্ডে ‘বিভ্রান্ত বসন্ত’ ও ‘চৈতালী’, তয় খণ্ড ‘সূর্য স্বপ্নে’)বিস্তরমান ও প্রবহমান তরঙ্গশীল উপাখ্যানে জীবনের পলস্রোত যেন দুর্মর। অন্য আরেকটি ‘পদসঞ্চার’, ভারতে ইউরোপীয় শক্তির প্রথম পদার্পণ কাহিনী। ‘উপনিবেশ’ ও ‘পদচিহ্ন’-তে ব্যক্তিসত্তা অনেকটাই যুগসত্তায় লীন হয়। দুটি উপন্যাসের ইতিহাস-চিন্তা প্রবলভাবে অভ্যন্তরস্থিত কাহিনিকে গতি দেয়। অন্যদিকে ‘সম্রাট শ্রেষ্ঠী’ সামন্ত-পতন আর পুঁজি-উত্থানের কাহিনি।

‘উপনিবেশ’ দশ বছরের ঘটনাক্রমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যে-বাস্তবতা তার একটি রূপ মেলে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সূর্য-সারথি’তে। যদিও তার পটভূমি কলকাতা শহর। প্রায় একই পদক্ষেপে রচিত হয়েছে ‘শিলালিপি’, ‘লাল মাটি’। শিলালিপি কিংবা উপনিবেশ থেকে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সাহিত্যদর্শের যে-রেখাটি চিহ্নিত করা যায় তা লাল মাটিতেও অনুল্লেখ্য নয়। ইতিহাসের ছায়ায় এ-কালের পুনর্গঠন। সে-লক্ষ্যে নির্মিত ভাষা। সে-ইতিহাস কীসের? কার? দিব্যক, ভীম, আদিনার সাঁওতালরা, শূদ্রশক্তির উত্থান ঠিক যেমনটা দেশমাতার স্বাধীনতার জন্য রঞ্জনের নেতৃত্বে গণশক্তির উত্থান, উপনিবেশের পরিবর্তনে শেষ পর্যন্ত উঠে আসে জনতার মুষ্টিযোগ চেতনা, সম্রাট ও শ্রেষ্ঠীতে রাজা ও প্রজার ঐক্য আর একইসঙ্গে প্রান্তিক বা নিম্নবর্গের অধিকার চেতনার অভেদ-স্বরূপ – নিজস্ব কৃষ্টির ভেতরে তাদের জয়োল্লাসের অন্তর্লীন চেতনাই ঔপন্যাসিকের সমর্থিত প্রতিপাদ্য।

‘পদসঞ্চার’ সমাজ-ইতিহাসের জড়ানো-প্যাঁচানো জটিল ইতিহাস। তাতে জ্ঞান সৃজন করেছেন লেখক।‘ স্রোতের সঙ্গে’ তেও সমাজ ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। ১৯৬৭ সালের ক্ষমতাসীন যুক্তফ্রন্ট যে আশা ও আশাভঙ্গের দ্বন্দ্ব তৈরি করে তার সঙ্গে মিশে যায় প্রবীর-সাবিত্রীর মতো চরিত্র। ‘কলধ্বনি’ র সৌরীন-এণাক্ষীর জটিল রসায়ন এক অর্থে পুরো আখ্যানে জমিয়ে তোলে সামন্ততান্ত্রিক মনোভাবের করাল থাবার  চিহ্ন। উপন্যাস হিসেবে এগুলি কি  তেমন তাৎপর্যপূর্ণ? না হলেও সমাজ বাস্তবতার ইঙ্গিতটি সাফলভাবেই পাঠকের কাছে প্রকাশিত হয়। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় যে প্রেমের উপন্যাস লিখেছেন। সে-প্রেম একইসঙ্গে অবসাদ ও রোমান্টিকতায় মোড়ানো। নগর মধ্যবিত্তের সহজাত চাপ ও আবেগে জর্জরিত। সেখানে তাঁর আঙ্গিক আলাদা। এ-ধরনের উপন্যাস ‘স্বর্ণ সীতা’, ‘রোমান্স’, ‘নিশিযাপন’, ‘কৃষ্ণচূড়া’, ‘ভস্মপুতুল’।  তা স্বত্বেও এ ধরণের উপন্যাসের সমাজদ্বন্দ্ব গুরুত্বকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। রাজনীতি নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়; প্রচ্ছন্ন বা প্রত্যক্ষভাবে তিনি রাজনৈতিক উপন্যাস লিখেছেন। যেমন : অসহযোগ ও সশস্ত্র আন্দোলনের পটভূমিতে ‘তিমির-তীর্থ’, দেশভাগ নিয়ে ‘বিদিশা’। এছাড়াও সমাজবৃত্তান্ত নিয়ে ‘নতুন তোরণ’, ‘আলোকপর্ণা’র মতো উপন্যাসও লিখেছেন।