অদ্ভুতুড়ে

মাঝসমুদ্রের জাহাজ থেকে যাত্রী চালক উধাও  

By admin

April 18, 2024

গভীর সমুদ্রে ভেসে বেড়াচ্ছে একটি জাহাজ। বায়নোকুলার দিয়ে তাকে দেখে একটু অবাক হলেন দেই গ্রাটিয়া জাহাজের ক্যাপ্টেন ডেভিড মোরহাউস। জাহাজটি তার পরিচিত- মেরি সেল্যাস্ট। জাহাজটি তার জাহাজের থেকে প্রায় আট দিন আগে নিউ ইয়র্ক বন্দর ছেড়েছিল ইতালির জেনোয়ার উদ্দেশ্যে। এত দিনে মেরি সেল্যাস্টের ইতালির বন্দরে পৌঁছে যাবার কথা! কিন্তু এত দূরে উদ্দেশ্যহীনভাবে জাহাজটি ভাসতে দেখে ক্যাপ্টেন দেরি না করে নিজের জাহাজের নাবিকদের মেরি সেল্যাস্টের কাছে জাহাজ নিয়ে যেতে নির্দেশ দিলেন।

কাছাকাছি পৌঁছেও মেরি সেল্যাস্ট থেকে সাড়াশব্দ না পেয়ে ক্যাপ্টেন উদ্ধারকারী নৌকা পাঠালেন। দেই গ্রাটিয়া জাহাজের সবাই হতবাক, মেরি সেল্যাস্ট কোনো চালক ছাড়াই ভেসে বেড়াচ্ছে! কোনো আক্রমণ, মহামারি, দুর্ঘটনার চিহ্ন নেই অথচ মানুষগুলো যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। জাহাজ তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাওয়া গেল না কোনো নাবিক বা ক্যাপ্টেনের। জাহাজের বেশিরভাগ জিনিস একেবারে গোছগাছ করা অবস্থাতেই রয়েছে। বোঝার উপায় নেই আসলে কী ঘটেছে।

পুরো জাহাজ ভালোভাবে খুঁজে আরও অবাক হল দেই গ্রাটিয়ার নাবিকেরা। খাবারের গুদামে যে পরিমাণ রসদ আর পানীয় আছে তাতে জাহাজের সবার প্রায় ৬ মাস সহজেই চলে যাবার কথা। কোনো ধস্তাধস্তি কিংবা আক্রমণের চিহ্ন নেই কোথাও। জামা-কাপড়, নিত্য ব্যবহার্য সব কিছুই রয়েছে স্বাভাবিক অবস্থায়। ক্যাপ্টেনের ঘরে পাওয়া গেল তার এবং তার স্ত্রীর পোশাক, বাচ্চার খেলনা আর বিছানার নিচে পাওয়া গেল খাপে ভরা একটি তলোয়ার। তাহলে জাহাজ ছেড়ে সবাই কোথায় চলে গেল।  জাহাজটিতে ছিল একটি মাত্র লাইফবোট, কিন্তু সেই লাইফবোটটি কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না।

তবে কি আগাম কোনো বিপদের খবর পেয়ে সবাই জাহাজ ছেড়ে তড়িঘড়ি সরে পড়েছিল, নাকি কোনো এক অদৃশ্য ক্ষমতা তাদের গায়েব করে দিয়েছে? যাই হোক মেরি সেল্যাস্টের দশজন যাত্রির আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি। ১৮৭২ সালের ৫ নভেম্বর ২৮২ টনের ব্রিগেন্টিন জাহাজটি দু’সপ্তাহের সামুদ্রিক ঝড়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে অ্যাজোর্সে পৌঁছায়, তারপর অজ্ঞাত কোনো কারণে সবাই হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। ওই ভুতুড়ে জাহাজটি খুঁজে পাওয়ার দশ দিন পর দেই গ্রাটিয়া জাহাজের ক্যাপ্টেন এবং কর্মীরা মেরি সেল্যাস্টকে ৮০০ মাইল দূরে জিব্রাল্টায় ব্রিটিশ নৌবিভাগের আদালতে নিয়ে আসে, জাহাজ উদ্ধারের পুরস্কার এবং বীমা কোম্পানির কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ। কিন্তু তিন মাস ধরে তদন্তের পর জাহাজে কোনো ধরনের অস্বাভাবিক কার্যকলাপ হয়নি বলে সিদ্ধান্তে আসে আদালত। কিন্তু দেই গ্রাটিয়া জাহাজের ক্যাপ্টেন এবং অন্য কর্মীরা বীমার অর্থের মাত্র এক-ষষ্ঠাংশ হাতে পায়। কারণ গ্রাটিয়া জাহাজের কুশলীরা মেরি সেল্যাস্টের যাত্রীদের নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে জড়িত ছিল কি না সেই বিষয়ে আদালত সম্পূর্ণ নিশ্চিত নয়।

অদ্ভুত এই অন্তর্ধানের খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে তৈরি হতে থাকে নানা ধরনের গল্প। লোকমুখে মূল কাহিনী বদলে মেরি সেল্যাস্ট হয়ে ওঠে অতিপ্রাকৃত এক জলযান। আর্থার কোনান ডয়েল ‘কর্ন হিল’ ম্যাগাজিনে মেরি সেল্যাস্টের যাত্রীদের রহস্যময় অন্তর্ধানের উপর ভিত্তি করে একটি গল্প লেখেন। তাতে ফের পুরোনো সেই কাহিনি নতুন করে সবার আগ্রহে পরিণত হয়। তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল ফাইল পুনরায় খোলার নির্দেশ দেন এবং কেসের পুরোনো ফাইলগুলো আবারও ঘেঁটে দেখেন। কিন্তু নিখোঁজ যাত্রীদের অন্তর্ধান রহস্যের কোনো সমাধান তিনি করতে পারেননি।

মেরি সেল্যাস্টের যাত্রী নিখোঁজ হওয়া নিয়ে লোকমুখে নানা তত্ত্ব তৈরি হতে থাকে, যার কিছু রুপকথার মতো, কিছু বাস্তব। তবে এত কিছু ঘটে যাবার পরও মালিক পক্ষ মেরি সেল্যাস্টকে কিন্তু পরিত্যক্ত ঘোষণা করেনি। বেশ কয়েকবার মালিক বদল হলেও বহাল তবিয়েতেই সমুদ্রযাত্রা অব্যাহত থাকে জাহাজটি। কিন্তু দুর্ভাগ্য নিয়ে যে জাহাজের যাত্রা শুরু, তার শেষও দুর্ভাগ্য দিয়েই হয়। ১৮৮৫ সালে মেরি সেল্যাস্টের তৎকালীন মালিক ক্যাপ্টেন জি সি পার্কার বীমার টাকার লোভে হাইতির কাছাকাছি অঞ্চলে ইচ্ছাকৃতভাবে জাহাজের সাথে প্রবাল প্রাচীরের সংঘর্ষ ঘটান। কিন্তু অনেক ক্ষয়ক্ষতি হলেও মেরি সেল্যাস্ট ডুবে যায়নি। বীমা কোম্পানি বিষয়টি ধরে ফেলে এবং আর্থিক সহায়তা দিতে অস্বীকার করে। সংস্কারের অযোগ্য হয়ে যাওয়ায় মেরি সেল্যাস্টের জীবনকাহিনী শেষ হয় সেখানেই।