লন্ডনের রিৎজ হোটেলের বাইরে সেদিন তাঁর জন্য কয়েক লক্ষ মানুষ অপেক্ষা করছিল। হোটেলের নীচের রাস্তায় মানুষের ভীড় সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছিল পুলিশ। আশপাশের উঁচু উঁচু বাড়িগুলি ঢাকা পড়েছিল বিশালাকার সব প্ল্যাকার্ডে। যেখানে বিরাট বিরাট অক্ষরে লেখা ছিল ‘চার্লি অ্যারাইভ্স’। সেই জনসমুদ্র আর মানুষের প্রবল উচ্ছাস দেখে চার্লি চ্যাপলিনের নিজের ছোটবেলার কথা মনে পড়লো। ছোটবেলায় লন্ডনের ঠিক এই রাস্তার ধারে দাঁড়িয়েই তিনি দেখতেন, তৈরি হচ্ছে গগনচুম্বী রিৎজ হোটেল। আর আজ সেই বিলাসবহুল হোটেলের ম্যানেজার নিজে এসে তাঁকে অভ্যর্থনা জানালেন এবং তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে তাঁর ঘরে পৌঁছে দিয়ে গেলেন। চার্লি ঘরের দরজা দিয়ে ঢুকেই দেখলেন ঘর ভর্তি গোলাপের স্তবক আর শুভেচ্ছাবার্তা। একটু যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন তিনি।
ঘর থেকে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াতেই তিনি লক্ষ্য করলেন, তাঁকে দেখে জনসমুদ্র উত্তাল হয়ে উঠল, তাঁর উদ্দেশে হাজার হাজার মানুষ সমস্বরে বলতে থাকল, ‘গুড লাক চার্লি’, ‘ওয়েল ডান চার্লি’, ‘গড ব্লেস ইউ চার্লি’। মনে হতে লাগল যেন বিশ্বজয় করে রাজা ফিরেছেন ঘরে। চার্লি এবার সত্যি সত্যিই আনমনা হয়ে গেলেন। নিজের মনেই বলে উঠলেন, ‘এত ভালবাসা কি আমার প্রাপ্য?’ কিন্তু মাথা নত করে এই অভ্যর্থনা গ্রহণ করা ছাড়া যেন কিছুই করার নেই তাঁর। হাসি হাসি মুখ করে তিনি জনতার উদ্দেশ্য হাত নাড়লেন। জনসমুদ্র আরও উত্তাল হয়ে উঠল। এরপর তিনি চুম্বন ছুড়ে দিলেন আকাশের দিকে। ঘর থেকে নিয়ে এলেন কয়েকটি গোলাপ। একটি একটি করে সেই গোলাপ ছুঁড়ে দিতে থাকলেন তাঁর ভক্তদের দিকে। হুড়োহুড়ি পড়ে গেল সেই গোলাপ কুড়োতে। কিন্তু আর নয়, এরপরেই গোলাপ ছুড়তে গিয়ে তাঁর হাত থেমে গেল।
বাকি গোলাপগুলি নিয়ে হোটেলের ব্যালকনি থেকে ঘরে ফিরে এলেন চ্যাপলিন। ইতিমধ্যে তাঁর ঘরে হাজির হতে শুরু করেছেন সাংবাদিক, সিনেমাজগতের লোক, ক্যামেরাম্যান থেকে শুরু করে আরও বিশিষ্টজনেরা, গোটা হোটেলটাই গমগম করছে তাঁদের ভীড় আর অভ্যর্থনায়। সবাই চ্যাপলিনকে একবার দেখতে চাইছেন, তাঁর সঙ্গে দু-একটা কথা বলতে চাইছেন। অথচ চার্লির কিন্তু এসবের কিছুই ভাল লাগছে না। তাঁর ইচ্ছে করছে রিৎজ হোটেলের সব কিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে ছুটে চলে যেতে মন চাইছে পাওনাল টেরাস-এর ছেলেবেলার বাড়িটার সামনে। অবস্থা বুঝে শুনে চ্যাপলিন ঘোষণা করলেন, তিনি খুব ক্লান্ত, তার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে তাই তিনি একটু ঘুমতে চান। সম্ভব হলে তিনি রাতে ডিনারের পর সবার সঙ্গে দেখা করবেন। অগত্যা একে একে সবাইএ বিদায় নিতে হল।
সবাই চলে যাবার পর চার্লি তাঁর জামা প্যান্টটা চট করে বদলে ফেললেন। তাঁকে যেভাবেই হোক এই হোটেল থেকে বেরোতে হবে। কিন্তু এত নিরাপত্তা, এত লোকজনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে তিনি কী বেরোতে পারবেন? চার্লির মাথায় একটা বুদ্ধি খেললো, তিনি হোটেলের যে লিফট দিয়ে মালপত্র ওঠানামা করে সেটা করেই নীচে নেমে এলেন। কিন্তু এবার? চারদিক দেখে নিয়ে তিনি হোটেল থেকে বেরিয়েই পিছনের রাস্তায় পেয়ে গেলেন একটা ট্যাক্সি। ড্রাইভারের সিটে বসে রয়েছেন এক বৃদ্ধ। সময় নষ্ট না করেই চার্লি লাফিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে পড়ে বললেন, ‘ল্যাম্বেথ যাব, তাড়াতাড়ি চলো’। চার্লির ভাগ্য ভাল বলতে হবে, ট্যাক্সি ড্রাইভার চার্লি চ্যাপলিনকে চিনতে পারেননি!
ট্যাক্সি ছুটছে হে মার্কেট দিয়ে ট্র্যাফালগার স্কোয়ার, পার্লামেন্ট স্ট্রিট হয়ে ট্যাক্সি এবার এসে উঠল ওয়েস্টমিনস্টার ব্রিজে। ব্রিজ পেরিয়ে মোড় ঘুরতে না ঘুরতেই সময় পিছিয়ে গেল দশ বছর। চার্লির চোখে পড়ল বোহেমিয়ান কোয়ার্টার, লন্ডনের উঠতি সঙ্গীতশিল্পীরা এখানেই ভিড় জমান। তার পর কেনিংটন রোড। শিশুর মতো চোখ মেলে চার্লি দেখছেন আর কেবলই তাঁর মনে হতে থাকলো প্রায় কিছুই তো বদলায়নি, সব আগের মতোই আঃছে। ওই তো চেস্টার স্ট্রিটের কেনিংটন পাব। তার কিছুটা দূরে সেই দোকান, এখানে তিনি ছেলেবেলায় কাজ করেছেন। কিন্তু পাওনাল টেরাসে ট্যাক্সি ঢোকার মুখেই তিনি ড্রাইভারকে থামতে বলে নেমে পরলেন। কোনোদিকে না তাকিয়ে তিনি আস্তে আস্তে হাঁটতে থাকলেন। কিন্তু হাঁটতে পারলেন না, কয়েক পা এগিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি। চার্লির মনে হল এ তো তাঁর শৈশবের বাড়ি নয়, এতো এক জীর্ণ কঙ্কাল।
ভাবতে ভাবতেই তাঁর ঘোর ভেঙে গেল। বেশ কিছু মানুষ ফিসফিস করে বলছে, ‘ওই তো। ওটাই চার্লি চ্যাপলিন!’ ফিসফিস গুঞ্জনে পরিণত হল, বাড়তে থাকল ভিড়। চ্যাপলিন একটু ভয় পেয়ে গেলেন, তিনি তো এখন একা, তাঁকে মানুষ চিনতে পেরেছে, এবার মানুষের ঢল নামলে তিনি কী করে সামলাবেন? দূরে পুলিশ দেখে তিনি এগিয়ে গিয়ে উৎকণ্ঠার সঙ্গে বললেন, ‘আমি চার্লি চ্যাপলিন। আমাকে লোকে চিনে ফেলেছে। দয়া করে আমাকে একটা ট্যাক্সিতে তুলে দিন’। চার্লির কথা শুনেই পুলিশ বুঝতে পারলেন যে তিনি ভয় পেয়ে গিয়েছেন। ঠান্ডা গলায় পুলিশ বললেন, ‘আপনার চিন্তার কোনো কারণ নেই, আমি এখানেই থাকি, এদের সবাইকে চিনি, আপনার কোনও বিপদ হবে না’।
কথাটা যেন চার্লির বুকের মধ্যে গিয়ে অন্য ভাবে ধাক্কা দিলো। সত্যিই তো এটা তো তাঁরই পাড়া! এরা সবাই তাঁরই প্রতিবেশী। তিনি এঁদের মধ্যেই বড় হয়েছেন এঁদের কাছে তাঁর কিসের ভয়? তবে কি সাফল্য মানুষকে এত ভিতু করে দেয়? চার্লি নিজের আচরণের জন্য নিজেই লজ্জা পেলেন। মাথাটা তাঁর নিজের কাছেই হেঁট হয়ে গেল। আবেগ সামলে নিয়ে চার্লি হাসিমুখ করে সেই মানুষগুলির দিকে তাকালেন। এতক্ষণ যারা সঙ্কোচে দূরে দাঁড়িয়ে চিলেন তারাও হাসি মুখে চার্লির কাছে এগিয়ে এলেন। না এখানে কেউ কোনো উচ্ছাস বা উত্তেজনা প্রকাশ করলো না। কোনো কোলাহল হল না। সবাই শান্তভাবে চার্লির সঙ্গে হাত মেলালেন, শুভেচ্ছা জানালেন। চার্লিও তাদের অনেক শুভেচ্ছা জানালেন। সেদিন চার্লির ফেরার পথ ছিল হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার মতো, সেদিন ফেরার সময় চার্লি ভেবে দেখলেন এখানে কেউ তাঁকে ‘মিস্টার চ্যাপলিন’ বা ‘স্যার’ বললেন না।