%%sitename%%

প্রবাসীর ডাইরি

কাতার দেশটায় পা দিয়েই বদলে গেল ধারণাটা

By admin

July 31, 2020

তীর্থঙ্কর

আমি কর্মসূত্রে ২০১৭’র মার্চ মাসে কাতারে এসেছি। এটাই আমার প্রথমবার, দেশের বাইরে পদার্পণ। যদিও সামরিক বাহিনীতে চাকরির সুবাদে, ভারতবর্ষের অনেক রাজ্যের মানুষের জীবনযাত্রা কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে; কিন্তু, এখানে আসার আগে বিদেশ, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর জীবনযাত্রা এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে কোনো সুষ্পষ্ট ধারণাই ছিলো না আমার। কানাঘুঁষো যা শুনেছিলাম, তাতে কাতার, সৌদি আরব, বাহরিন, তুর্কি, জর্ডন – এইসব দেশগুলো সম্পর্কে একটা চাপা আতঙ্কই ছিলো মনে মনে। তাই মিথ্যে কথা বলব না, ২০১৭’র ২৭ শে মার্চ, মুম্বাই বিমানবন্দর থেকে দুরুদুরু বুকেই, জীবনে প্রথমবার আন্তর্জাতিক উড়ানে উড়েছিলাম। তারপর, বিগত তিন বছরের একটু বেশি সময় ধরে অনেক কিছুই দেখলাম, যা মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্কে আমার ভুল ধারণা গুলোকে একদম বদলে দিয়েছে।

প্রথমে, এসেই যেটা দেখে চমৎকৃত হয়েছিলাম, সেটা হচ্ছে এখানকার ঝা চকচকে রাস্তাঘাট, পার্ক, মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং, শপিং মল – সবকিছুই একদম ছবির মতো সুন্দর। কোথাও ছিঁটেফোঁটা ময়লা বা আবর্জনা নেই। একটা গোটা দেশ, অথচ সেখানে কোথাও কোনো গরিব নেই। কাউকে না খেতে পেয়ে মরতে হয়না, একটাও ভিখারি নেই! আমার তো কিছুক্ষণের জন্য মনে হয়েছিলো, ‘দাস ক্যাপিটালে’ কার্ল মার্ক্স যে সমাজতন্ত্রের কথা বলে গেছেন, এ যেন তারই এক বাস্তব চিত্র। পরে অবশ্য, আমার সে ভুল ধারণা পাল্টে যায়। কাতার আসলে একটি ধনতান্ত্রিক দেশ। আমি এতকাল জানতাম, আমেরিকা পৃথিবীর সব থেকে ধনী দেশ। এখানে এসে বুঝলাম, ‘প্রতিপত্তিশালী বা প্রভাবশালী’ আর ‘বিত্তশালী বা ধনী’ দুটো সম্পূর্ণ ভিন্নভিন্ন তাত্ত্বিক বিষয়, যেগুলোকে জোর করে, এক’ই বিষয় বলে আমাদের ওপরে চাপিয়ে দেওয়া হয়। আমেরিকা এই পৃথিবীর সব থেকে প্রভাবশালী দেশ হতে পারে; কিন্তু, ‘পার ক্যাপিটা ইনকাম’ অনুযায়ী, কাতার – বিশ্বের সব চাইতে ধনী দেশ। আমি এই তিন বছরে আরো যা যা জানতে পেরেছি, সেগুলো এবার একটু একটু করে, গুছিয়ে বলার চেষ্টা করি।

কটা গোটা দেশ, অথচ সেখানে কোথাও কোনো গরিব নেই। কাউকে না খেতে পেয়ে মরতে হয়না, একটাও ভিখারি নেই! আমার তো কিছুক্ষণের জন্য মনে হয়েছিলো, ‘দাস ক্যাপিটালে’ কার্ল মার্ক্স যে সমাজতন্ত্রের কথা বলে গেছেন, এ যেন তারই এক বাস্তব চিত্র।

কাতার পশ্চিম এশিয়ার আরব দেশগুলোর মধ্যে, তিনদিকে পারস্য উপসাগর দ্বারা বেষ্টিত এবং একদিকে মূল ভূখণ্ডের সাথে যুক্ত একটি ছোট্ট উপদ্বীপ। দেশটির আয়তন মাত্র ১১,৫৭১ বারগ কিলোমিটার। সমুদ্র উপকূলগুলো ছাড়া, বাকি সম্পূর্ণ দেশটিই মূলত মরু অঞ্চল। স্থলভাগে কাতারের একমাত্র প্রতিবেশী দেশ হচ্ছে সৌদি আরব। দেশদুটি আন্তর্জাতিক সীমান্ত রেখা দ্বারা বিচ্ছিন্ন। এছাড়াও কাতার – ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী এবং বাহরিনের সাথে সমুদ্রসীমা দ্বারা সংযুক্ত। কাতারের মোট জনসংখ্যা ২৭ লক্ষ ৮৮ হাজার, যাদের মধ্যে মাত্র সাড়ে তিন লক্ষ মানুষ মূল ভূখণ্ডের অধিবাসী বা প্রকৃত কাতারি। বাকি জনসংখ্যা – মিশর, সুদান, মালি, প্যালেস্টাইন,ইয়েমেন, তুর্কি, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাঙলাদেশ, ভারতবর্ষ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপিন্স, চীন, আমেরিকা এবং আরো বহু দেশ থেকে জীবিকার সন্ধানে আসা মানুষের সমষ্টি।

৫০,০০০ বছর আগেও যে কাতারে মানুষ বাস করতো, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে প্রস্তরযুগের অস্ত্রশস্ত্র এবং হাতিয়ার উৎখননের মাধ্যমে। নিয়োলিথিক কালে মেসোপটেমিয়ান সভ্যতার আধিপত্য বিস্তৃত হয়েছিলো কাতারে। সমুদ্র উপকূলবর্তী সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ থেকে পাওয়া মাটির বাসনপত্র, তারই সাক্ষ্য বহন করছে।

ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে এই উপদ্বীপটি বিভিন্ন সাম্রাজ্যের দ্বারা শাসিত হয়েছে, যাদের মধ্যে সেলুসিড, পার্থিয়ান এবং সেশানিয়ান শাসকদের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে এই উপদ্বীপটির অধিবাসীরা সর্বপ্রথম ইসলাম শব্দটির সাথে পরিচিত হন, যখন হজরত মহম্মদ, মুনজির ইবন সাওয়াকে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে কাতারে পাঠান। অষ্টম শতাব্দীতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে কাতার মুক্তা উৎপাদক এবং রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বিশ্বের দরবারে পরিচিতি পায়। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দশকে মাটির নিচে বিশাল তৈলভান্ডার আবিষ্কার হবার আগে, কাতার খুবই দরিদ্র এবং অনুন্নত একটি দেশ ছিলো। মূলত মুক্তার সন্ধান, সমুদ্রে মৎস্য শিকার এবং পশুপালনই ছিলো কাতারবাসীদের মুখ্য জীবিকা।

১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে বনি উথবা নামের একটি আরব উপজাতি বাহরিন দখল করলে, আরবের আল খলিফা, বাহরিন এবং কাতারে খলিফা শাসন পত্তন করেন। ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে অটোমান সাম্রাজ্য পূর্ব আরব পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করলে, কাতার অটোমান শাসনের অধীনস্ত হয়। তবে, ১৯১৫ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে, অটোমানরা কাতার থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে নেয়। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে কাতার একটি ব্রিটিশ সুরক্ষিত রাজ্যে পরিণত হয়। কাতারের তদানীন্তন আমির আব্দুল্লা আল থানি, একটি চুক্তিপত্র স্বাক্ষরের মাধ্যমে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনতা স্বীকার করেন। সেই চুক্তিপত্রে লেখা ছিলো – কাতার, সকল প্রকার সামুদ্রিক এবং স্থলপথে আক্রমণের হাত থেকে সুরক্ষার বিনিময়ে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনস্থ হচ্ছে।

( চলবে)