ঘুরে-ট্যুরে

উত্তর সিকিমের ডায়েরি-১

By admin

August 21, 2020

ইন্দ্রনীল বসু। ছবি: প্রতিবেদক

পাহাড়কে যতবারই দেখি মন ভরে না। এ যেন এক নেশা। হিমালয় নামটার মধ্যেই কেমন যেন একটা আনন্দ আর মাদকতা আছে, নস্টালজিয়া আর রোমান্টিসিজম মিলে মিশে একাকার। এই ইট , কাঠ, ধুলো, বালির শহর থেকে দিন কযেকের মুক্তি। লোকে পাগল ভাববে কিন্তু তাও বলেই ফেলি কথাটা। যতবার হিমালয় গেছি মনে হয়েছে এখানে একটা বাড়ি করে থেকে যাই। আর ফিরবো না কলকাতায়। অমন স্নিগ্ধ, সুন্দর রূপ, বরফে মোড়া পাহাড়চূডা , কত অচেনা অজানা পাখির কলকাকলি, কমলালেবুর মিষ্টি স্বাদ- সে সব ছেড়ে কি আর আস্তে ইচ্ছা করে ! এ জীবনে হিমালয় অধরা মাধুরীই রয়ে গেলো। কেন তারে ধরিবারে করে মন অকারণ ….. এই ভদ্রলোক বোধ হয় বাঙালির সব সেটিমেন্ট নিয়েই খেলা করে গেছেন অবলীলায়।

আসল কথায় আসি। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। দুই বন্ধু ঠিক করলাম পাহাড়ে যাবো। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। ট্রেনের টিকিট পেলাম না। শিলিগুড়ি রকেটে চেপে বসলাম । গন্তব্য গ্যাংটক। সেখান থেকে যাবো ইয়ুমথাং আর গুরুদ্রংমার। যাবার আগে মা বলে দিলেন, গ্যাংটকে মায়ের এক বন্ধু থাকেন, রোজা। ওনার সঙ্গে যেন অবশ্যই দেখা করি। একসঙ্গে স্কটিশ কলেজে পরতেন। পরে এক-দু’বার আমাদের বাড়িও এসেছেন। সেই সূত্রে আমার সঙ্গেও পরিচয় ছিল। মাকে হূ বলে বেরিয়ে পরলাম বন্ধু অনিমেষকে নিয়ে। গ্যাংটক পৌঁছলাম যখন তখন ঝির ঝির বৃষ্টি পড়ছে। ছাতা মাথায়, এ হোটেল ও হোটেল ঘুরে একটা জায়গা জুটে গেলো মাথা গোঁজার। পকেটে বেশি রেস্ত নেই। খরচ করতে হবে বুঝে শুনে। তাই প্রথম দিকে যতটা বাঁচানো যায় সেই চেষ্টায় ছিলাম দুজনে। সেদিন আর কিছু হলো না। চিকেন স্যুপ আর চাউমিন পেট পুরে খেয়ে সটান শুয়ে পরলাম। রাতে বেশ বৃষ্টি হচ্ছিল।

সকালে উঠে দেখি ঝলমল করছে আকাশ। ঠিক হলো, সেদিন গাংটকটা দেখে পরদিন গুরুদ্রংমার রওনা দেব। একটা গাড়ি পাকড়াও করে দরদাম হলো। বেরোনোর আগে রোজা মাসীকে ফোন করে বললাম সন্ধ্যায় দেখা হবে। কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ রূপ দেখলাম হনুমান টক থেকে। এই দেখার জন্যই তো আসা। এর আগে দার্জিলিং থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেছি। সেকানকার এক রূপ, এখানকার অন্য। বলতে দ্বিধা নেই, দার্জিলিঙের রূপ অনন্য। অন্যান্য বৌদ্ধ গুমফা গুলোও দেখলাম। কিন্তু সবথেকে ভালো লাগলো রূমটেক মনাস্টেরি। তিব্বতী কারুকার্য মন্ডিত। বেশ ভিড়। এখানে অনেক লামাদের একসঙ্গে থাকার জায়গা আছে। ছোটবেলা থেকে এখানে লামাদের বৌদ্ধ ধর্ম শিক্ষা দেওয়া হয়। বিরাট বড় চত্বর। এটাই সিকিমের সবথেকে বড় মঠ। গ্যাংটক ফিরে এলাম দুই বন্ধু। অনিমেষের এই প্রথম পাহাড় দর্শন। একটু উত্তেজিত দেখাচ্ছিল ওকে। অমন সুন্দর প্রকৃতি , আঁকাবাঁকা পথ, সহজসরল পাহাড়ি মানুষ – ভালো তো লাগবেই। গ্যাংটক শহরে ফিরতে দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। অনিমেষ আর আমি রোজা মাসীর বাড়ি গেলাম। আমাদের দেখে সে কি আনন্দ! পাহাড়ি লোকজন খুব মিশুকে হয়। অতিথিপরাযন ও বটে। স্বামী , ছেলে স্টিফেন আর মেয়ে সিমরান এর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। বাইরের ঘরটায় কাঞ্চনজঙ্ঘার একটা বড় ছবি, ঘরে দামী কার্পেট। মার কথা জিজ্ঞেস করলেন। কলেজের গল্প করলেন। বললেন ডিনার করে যাবে। সিমরান বেশ হাসিখুশি। ওর সঙ্গে খুব আলাপ জমে উঠলো আমার। দেখতে খুব মিষ্টি। কিছুক্ষণের মধ্যেই চিকেন ফ্রাইড রাইস, সুপ আর বাড়িতে তৈরি মোমো নিয়ে এলো। রাস্তায় , হোটেলে অনেক মোমো খেয়েছি। কিন্তু তিব্বতী বাড়ির হাতে তৈরি মোমোর স্বাদই আলাদা। কথায় কথায় সিমরান বললো ও একটা ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করে। কলকাতায় ও গেছে একবার। কিন্তু বড্ড ভিড়ভার। রাস্তা পার হতেই ভয় করে। ডিনার শেষ করে সবাইকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পরলাম। গুরুদ্রংমার খুব ঠাণ্ডা। আগে থেকেই সাবধান বানী শুনিয়ে দিল সিমরান। বেশি হাঁটাচলা করতে বারণ করল। অনেকের নাকি শরীর খারাপ করে । হোটেল ফিরে শুয়ে পরলাম। সিমরানের মুখটা ভেসে উঠছিল বারবার। কেন এমন হয় ?

মে মাসের শেষ। গাড়ি ছুটলো শহর ছাড়িয়ে। ঠাণ্ডা হচ্ছে আবহাওয়া। বেশ বুঝতে পারছি। জানলা দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া এসে লাগছে চোখে মুখে। যত এগোই একের পর এক ঝর্না চোখে পরে। উঁচু পাহাড় থেকে সে ঝর্না নেমে আসে। রাস্তায় পড়ে আবার খাদে চলে যায়। কাবি, ফোদং, মঙ্গং, সিংহিক পেরিয়ে গাড়ি এসে থামলো চুংথাং। তার আগে অবশ্য দুবার ঝর্না দেখার ব্রেক ছিল। চা ও ভাগ্যে জুটেছে। চুংথাং অপূর্ব জায়গা। লাচুং আর লাচেন দুটো নদী এসে মিশেছে এখানে। ঘন সবুজে ঢাকা চারিদিক। মনে হলো পাইন, ওক আর দেওদার গাছ আছে অনেক। খাদের ধারে কয়েকটা দোকান। কোথাও চা,কোথাও বা নুডুলস, রাইস সব বিক্রি হচ্ছে। কোথাও আবার বেশ কয়েকজন জবুথবু হয়ে কাঠের আগুন জ্বালিয়ে বসে আছে। দুদিকে পাহাড়, মাঝখান দিয়ে দুটি নদীর কলকাকলি। ঠাণ্ডা এবার মালুম হচ্ছে। মে মাসেই এই। ডিসেম্বরে কি হয় ভাবা যায় ? ম্যাগি খেলাম দুই বন্ধুতে। চায়ে চুমুক দিয়ে একটা করে সিগারেট ধরালাম। পথের ক্লান্তি খানিকটা কাটিয়ে আবার বসলাম গাড়িতে। ড্রাইভার সাহেব জানালো, আউর বাইশ কিলোমিটার। ঘন সবুজের মধ্যে দিয়ে গাড়ি খানিকটা উঠে পরন্ত বিকেলে নামিয়ে দিলো লাচুং। উপত্যকাই বলা চলে। চারিদিকে উঁচু উঁচু পাহাড় । মাঝে ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম। দোতলা একটা ছোটো বাড়ি। সেটাই সেদিন রাতের আস্তানা। কিন্তু ওই ছোটো গ্রামখানা ঘুরে দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। কি শান্তি । নিস্তব্ধ চারিদিক। দূরে কোথাও একটা পাহাড়ি ঝর্না বয়ে চলেছে। সামনের একটা উঁচু ঢিবিতে ছোটো দুটো ছেলে খেলা করছে। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নেমে গেলো।

পরদিন খুব ভোরে উঠে রওনা দিলাম। ইয়ুমথাং গন্তব্য। লাচুং থেকে দুরত্ব তেইশ কিলোমিটার। এগারো হাজার আটশো ফুট উচ্চতায় ইয়ুমথাং। সকালের দিকটা বেশ কুয়াশা। এখানকার লোকে বলে ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স। যেতে যেতে বন্য ইয়াক দেখা গেলো। কুয়াশা ঢাকা মাঠে দাড়িয়ে ঘাস চিবোচ্ছে। গায়ের চামড়া মিশমিশে কলো। এখানকার মানুষ ইয়াকের দুধ খায়। ইয়ুমথাং পৌঁছে আমাদের দুই বন্ধুর আনন্দ আর ধরে না। চারিদিকে ফুলের বাহার। রডোডেন্ড্রন আর প্রিমুলা ফুলে ছাওয়া। ড্রাইভার বললো, এখন অনেকটাই কম। আর একটু আগে এলে জায়গাটা নাকি আরো সুন্দর লাগতো। তাও যা রূপ দেখলাম, মনে হলো যেন স্বর্গের নন্দনকানন। লাল, হলদে, ভায়োলেট, মেরুন কত যে তার রঙ তা আর বলে শেষ যাবে না। ইউমথাং নদীর ধারে এসে দাঁড়ালাম। পাথরের ওপর দিয়ে পাহাড় চিরে কল কল করে বয়ে চলেছে চিরচঞ্চলা হরিণী যেন। ফ্ল্যাশ, লাইট, অ্যাকশন ….. ক্যামেরার শাটার পড়ছে ট্যুরিস্টদের। ফটোসেশন চলছে নববিবাহিত মধুচন্দ্রিমায় আসা কপোত কপোতীর। কিছুক্ষণ থেকে মন ভরে না এখানে। তবু যেতে তো হবে। এরপর জিরো পয়েন্ট। বেশ উচ্চতায়। মে মাস। কিন্তু ঝির ঝির করে বরফ পড়ছে। টুরিস্ট গাড়িগুলো ভর্তি। পসরা সাজিয়ে বসে আছে দোকানিরা। পসরা মানে মদ আর রেড ওয়াইন। আর পারলাম না। ড্রাইভার সাহেব ততক্ষনে একটা বোতল তুলে নিয়েছেন। দুই এক গেলাসের বন্ধু একটু গলা ভেজালাম। বেশ দূরে বরফের একটা আস্তরণ পড়েছে। সামনেই শুনলাম চিন সীমান্ত। আর এগোনো বারণ। সেদিন ফিরে এলাম লাচেন। পরদিন যাবো গুরুদ্রংমার।

চলবে…