এক নজরে

উত্তরের রান্নাঘর

By admin

January 07, 2023

দ্বিতীয় পর্ব

বাঙালি( বাঙাল বা ভাটিয়া ), রাজবংশী, কোচ ছাড়াও উত্তরবঙ্গ জুড়ে বহু জনজাতির বসতি। যদিও তাদের প্রত্যেকে নিজেদের মধ্যে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান, গ্রহণ বর্জনের ফলে সম্প্রদায়গুলি তাদের মৌলিক সংস্কৃতি থেকে কিছুটা সরে এসে এক মিশ্র রূপ নিয়েছে। তবু কিছু কিছু আদি ও অকৃত্রিম প্রথা রয়ে গেছে অবিকল। ঐতিহ্যবাহী সেই সব সামাজিক প্রথার সঙ্গে সঙ্গে জনজাতির মানুষজনের খাবারদাবারের রয়েছে গভীর সংযোগ। উত্তরবঙ্গের চা-বাগান ও পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে জীবিকার সন্ধানে এক সময় বহু মানুষের সমাগম হয়। পরবর্তীতে যারা এই অঞ্চলের অধিবাসী হয়েই রয়ে যায়। বিহার, ওড়িশা, ছোট নাগপুর মালভূমি অঞ্চল, নিম্ন আসাম ও কাছাড় থেকেও বহু মানুষ এখানে এসে বসতি স্থাপন করেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছে তপশিলি জাতি ভুক্ত বেদিয়া, চামার ( রবিদাস ), কংকর, তপশিলি উপজাতিভুক্ত সাঁওতাল, মুন্ডা,ওঁরাঁ‌ও, রাভা, টোটো, অসুর, বাহার, হো, শবর, মেচ। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে গারো, তামাং,লেপচা, ভুটিয়া,রংপা প্রভৃতি বহু সম্প্রদায়ের লোকজন। এঁদের মধ্যে অনেকের আন্ত-সম্পর্ক রয়েছে বা পরবর্তীতে পাশাপাশি বাস করার কারণে বা বৈবাহিক সূত্রে একে অপরের খানাপিনা পোশাক পরিধানের আদান-প্রদান করেছেন। এই সব মিলিয়েই উত্তরের জনপদের বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যধারা বজায় আছে আজ‌ও।

উপজাতিভুক্ত সম্প্রদায়ের মানুষদের কিছু খাবার দাবারের তত্ত্বতালাশ করতে গিয়ে বিশেষ যা যা পেলাম:

কান্দা ভাপা: এটি ওরাঁও সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের ব্রেকফাস্ট জাতীয় খাবার। বিভিন্ন গাছের কন্দ যেমন মিষ্টি আলু, শিমুল আলু, গাছ আলু-এগুলো সেদ্ধ করে নুন চিনি ও মশলা যোগে সুস্বাদু করে তোলা হয়। তেলে ভাজার পরিবর্তে কেবল সেদ্ধ করেই করা হয় বলে এই পদটিকে ‘ ভাপাল’-ও বলা হয়। একেই আবার মুন্ডারা বলে ‘শাঙ্গা আয়ং’। যদিও এই ট্র্যাডিশনাল খাবারের পদটি ব্রেকফাস্টের টেবিল থেকে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে।

ফুকড়ি: এটা মাশরুম দিয়ে তৈরি একটি ডিস। পেঁয়াজ, রসুন, ঝাল সহযোগে তৈরি করা হয়। ভাত বা রুটির সঙ্গে পরিবেশন হয়।

আছে নানারকমের ভর্তা। আলু থেকে শুরু করে উচ্ছে পাতার ভর্তা, হলুদ পাতা, কচু পাতা, কলা পাতায় মুড়ে কাঁচা মাছের ভর্তা লেবু লংকা সহযোগে জনজাতির মানুষের অত্যন্ত প্রিয় খাবার।

টোটো জনজাতির প্রিয় খাবার গরুর মাংস। প্রকৃতিবাদী টোটোরা তাদের প্রধান উৎসব ওমচু এবং ময়ূ-তে গরু বলি দেন। দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গকৃত সেই মাংস বিনা তেলে শুধু মাত্র সেদ্ধ করে নুন মশলা মিশিয়ে খাওয়াই তাদের প্রথা ও প্রিয়।

নাপ্পি: চিংড়ি ও অন্যান্য ছোট মাছ লবণ মাখিয়ে রোদে শুকিয়ে তাকে গুঁড়ো করে জলের সঙ্গে মিশিয়ে ছোট ছোট মন্ড তৈরি করে নাপ্পি বানানো হয়।

চুঙ্গা শুটকি: অনেকটা রাজবংশী শিদলের মতোই মূলত বাঁশের চোঙের ভিতর তৈরি শিদল এটা। বাঁশের চোঙের ভেতর তেল মাখিয়ে একদিন রোদে রাখা হয়। ছোটো মাছের শুটকি হলুদ মাখিয়ে জল ঝরিয়ে চোঙায় চেপে চেপে ভরে মুখটা কলাপাতা, কাঁঠাল পাতা দিয়ে ভালো করে আটকে উনুনের পাশে বা উষ্ণ জায়গায় রেখে দেওয়া হয়। ১৫/২০ দিন পর শুঁটকি গলে গিয়ে আচারের মতো হয়। তীব্র গন্ধযুক্ত এই খাবার‌ও আদিবাসীদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়।

বাঁশের আচার: মূল খাবারের সঙ্গে টেস্ট মেকার আচার পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই খাওয়া হয়। আম, জলপাই, তেঁতুল,আমড়া, লেবু ইত্যাদি টক ফলের আচার আমরা সহজেই পাই। কিন্তু আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষদের একটি বিশেষ ধরনের খাবার হলো বাঁশের আচার। কচি বাঁশ গাছের কান্ড দিয়ে এই আচার প্রস্তুত করা হয়।

জনজাতিদের মধ্যে গারো সম্প্রদায়ের মানুষের কিছু ঐতিহ্যবাহী খাবারের পদ আছে।

ওয়াক বেন খারি: এটি শুকরের মাংসের পদ। গারো সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে শুকরের মাংস খুব জনপ্রিয়।

না’খাম খারি জাবা: এটি শুঁটকি মাছের একটি পদ। গারো ভাষায় জাবার অর্থ তরকারি, আর মি মানে ভাত।

দো’গপ্পা: বাঁশের চোঙের ভিতর তৈরি আঠালো ভাত আর দো’গপ্পা গারোদের দরবারি ডিস। দো’গপ্পা হলো মুরগির মাংস যা বিনা তেলে সোডা মিশিয়ে রান্না করা হয়। 

আজকের ফিগার ও হেলথ কনসাস নাগরিক জীবনেও এই পদটি অগ্রগন্য হতেই পারে ।