এক নজরে

অরাজনৈতিক প্রচার

By admin

April 24, 2024

‘আমি চাই মন্ত্রীরা প্রেম করুন সকলে নিয়ম করে, আমি চাই বক্তৃতা নয় কবিতা বলুন কণ্ঠ ভরে’। বছর কুড়ি আগের কথা। পাড়ার মোড়ে মোড়ে মাইক টাঙানো হত। তার নিচে আড়াআড়ি ভাবে ঝোলানো হত লাল টকটকে পতাকা। মাইকে বাজত বক্তৃতা। মাইকে শোনানো হত জ্যোতি বসুর ভাষণের ক্যাসেট। একটা সময় নাকি ইন্দিরা গান্ধীর বক্তৃতার ক‌্যাসেটও শোনাত কংগ্রেস। সেটা অবশ‌্য আরও আগে। বয়স্কদের কানে নাকি এখনও লেগে আছে আটের দশকের ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণ। বাজপেয়ীও সুবক্তা হিসাবে ছিলেন সর্বজনবিদিত। বাজপেয়ীর ভাষণও একই ভাবে বাজাতেন বিজেপি কর্মীরা। দলের শীর্ষ নেতা-নেত্রীরা যেখানে যেতে সময় পেতেন না, সেখানে ক্যাসেট-সিডিতে চলত তাঁদের বক্তৃতা। ইন্দিরা, রাজীব এমনকী বাজপেয়ীর মৃত্যুর পরও ভোটের প্রচারে তাঁদের জনপ্রিয় ভাষণ শোনানো হত। এখন সে রেওয়াজ উঠে গিয়েছে। বলা ভালো, শোনার মতো ভোট বক্তৃতা দেওয়ার লোক আর কই। রাজ্যের প্রধান চার দলের মধ্যে যে সুবক্তা নেই, এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। কিন্তু ভালো বক্তব‌্য পেশের সময়টা নেই। মানে আবহের কথা বলছি।

আমি এমন একজনের লোকসভা এলাকার মানুষে, শোনা কথা, তিনি নাকি দারুন বক্তৃতা পেশ করতেন সংসদে। ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত। তাঁর লোকসভা কেন্দ্রের ভোটার হলেও আমি কোনওদিন তাঁকে দেখার সুযোগ পাইনি। একবার শুধু দেখেছিলাম, সাদা ধবধবে অ‌্যাম্বাসাডারে ফরসা ভারী চেহারার একটা মানুষ। লোকসভা ভোটের আগে হয়তো তাঁকে দেখা যেত মোদিনীপুরের বিভিন্ন মহল্লায়। বেশিরভাগ সময়ই নাকি থাকতেন দিল্লিতে। কিন্তু ভোটের সময়, তাঁর বক্তব‌্য মাইক বাজিয়ে শোনানো হত। দলের কথা বলতেন। বুঝতাম না। ভোট চাইতে বিপক্ষ শিবিরকে নিশ্চিতভাবেই কটাক্ষ করতেন, কিন্তু এমন কোনও ভাষা ব‌্যবহার করতেন না, যা শুনে দাঁড়িয়ে পড়তে হত কাউকে। আর একটা কথা তখন তো ডিজে আসেনি বাজারে। মাইকের চোঙায় বাজত বক্তৃতা। ঠিক কী বলতেন, তা আজ আর মনে নেই। তবে মেদিনীপুর শহরে নির্বাচনী সভায় দেওয়া যে বক্তৃতা বাজানো হয়েছিল, তার কয়েকটি লাইন বলতে পারেন, পঞ্চায়েত প্রধান বিধায়ক, সাংসদের মধ্যে পার্থ‌ক‌্য বুঝতে সাহায‌্য করেছিল। যদিও, সেই বোঝা এখন গুলিয়ে যাচ্ছে। কেউ বলছেন, জিতলে পাড়ার রাস্তা হবে, কেউ বলছেন   রিয়ালিটি শোতে সুযোগ দেওয়া হবে, কেউ বলছেন হরিনাম সংকীর্তনের আসর বসবে ইত‌্যাদি এবং ইত‌্যাদি। তাহলে এগুলিই কী একজন সাংসদের কাজ? তাহলে বিধায়কদের, সভাধিপতি, পঞ্চায়েত প্রধানদের কাজ কী!

সেই ছোটবেলায় মাইকে বাজা ইন্দ্রজিৎ গুপ্তর বক্তৃতার সেই লাইনগুলি আজ খুব মনে পড়ছে। ‘আপনাদের পাড়ার রাস্তাঘাট নালা তৈরি করা আমার কাজ নয়। তার জন্য পঞ্চায়েত আছে, পৌরসভা আছে। দেশের অনেক বড় বড় বিষয় নিয়ে সংসদে আমাদের ব্যস্ত থাকতে হয়। তার জন্য আমাকে দিল্লিতেই থাকতে হয়। এখানে আমার বসে থাকলে চলবে না। তাতে আপনাদের ইচ্ছে হয় আমাকে ভোট দেবেন, না ইচ্ছে হয় ভোট দেবেন না।’ কেউ বলবেন সোজা কথা সোজা ভাবে বলেছেন। কেউ বলবেন ঔদ্ধত‌্য। সে সব বলতে পারেন। কিন্তু আমার মনে হয়, হে বঙ্গ ভান্ডারে তব বিবিধ রতনের মাঝে দাঁড়িয়ে গঠনমূলক সমালোচনা করতে পারা একটা শিল্পের মতো। কাউকে কষ্ট না দিয়েও সমালোচনা করে মন জয় করতে প্রয়োজন সহমর্মিতা ও সংবেদনশীলতা। মনে আঘাত না দিয়ে, বা অপেক্ষাকৃত কম আঘাত দিয়েও একজন মানুষকে এমনভাবে তার ভুল-ত্রুটিগুলো বোঝানো সম্ভব, আমরা কী বলতে চাইছি আর তার উদ্দেশ্য কী, সেটা অনেকাংশেই নির্ধারিত হয় কথার সুর বা টোনের ওপর। হয়তো কখনও কখনও গলা চড়িয়ে কথা বলার প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই শান্ত স্বরে, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ও কণ্ঠস্বরে শ্রোতার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই কথা বলা যায় এবং সেটাই করা উচিত বলে ধারণা। কিন্তু কী আশ্চর্য, বঙ্গ-রাজনীতির অভিধানে আপাতত ‘ট্রেন্ডিং’ খালিস্তান, বেহায়া, …ন্ডু-সহ ছাপার অযোগ্য আরও কিছু শব্দ। রাজনীতিকরা চড়া সুরে বিরোধীপক্ষকে নিশানা করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। সেটাই বঙ্গ-রাজনীতির বহু বছরের চেনা ছবি। কিন্তু ইদানীং এমন কিছু শব্দ তাঁদের মুখ থেকে বেরিয়েছে, যা না বললেই ভালো হতো বলে মনে হয়।

বাঙালিদের মধ্যে আগের কালে বিয়ের পর তো স্ত্রী স্বামীকে আপনি করে বলতো। তাতে প্রেম কমেনি। তারপর শুরু হলো তুমি তুমি… তাতেও প্রেম কমেনি। এখন চলছে তুই তোকারি। প্রেম কম হচ্ছে বলে মনে হয় না। কিন্তু তুই সম্বোধন না পরমপ্রিয় একটা সম্বোধন। কিন্তু রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা যখন মাইকের সামনে গলার শিরা ফুলিয়ে একে অপরকে তুই তোকারি করেন, তখন মনে হয় কোথায় হারিয়ে গেল ভোটের সেই সোনালী দিনগুলি…। সেদিন এক বন্ধু রাজনীতিবিদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। হার্ডকোর রাজনীতির অলিন্দে থাকা সেই বন্ধুটি এখন বেশ ক্ষমতাশালীও। দফতর সামলাতে হয়, সংগঠন দেখতে হয়, ভোটে জিততে হয় ইত‌্যাদি ইত‌্যাদি। কিন্তু রাজনীতির গড্ডালিকা প্রবাহে গা না ভাসিয়ে নিজের মতো করে কাজ করে যাচ্ছে বন্ধুটি। তাই সোজা চোখে আজকের ভাষা সন্ত্রাস বুঝতে পারে সে। বিরক্তও হয়। বলে, মূল বিষয়টাই হল রাজনীতি ব্যবসায় পরিণত হয়েছে এবং রাজনীতি থেকে রাজনীতিটাই ‘নাই’ হয়ে গিয়েছে। রাজনীতিকদের মধ্যে যে ধরনের ভাষার অপব‌্যবহার দেখছি, তারা নিজেরা তা দেখতে পাচ্ছেন না। কেননা, তাদের তো নেংটো রাজাকে তোমার জামা কই বলার মতো কেউ নেই। তাদের ঘিরে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেই তৈরি হয়েছে স্তাবকশ্রেণি। আমার মনে হয়, রাজনীতিতে আসতে গেলে রাজনীতির শিক্ষার চেয়ে বেশি প্রয়োজন, বেড়ে ওঠার শিক্ষা। বন্ধুর কথা হয়তো ঠিক। কিন্তু তারপরেও প্রশ্ন জাগে…কবে আমাদের রাজনৈতিক নেতারা আমাদের শুধুমাত্র ভোটার নয়, মানুষও ভাবতে শিখবেন?