এক নজরে

নিরুপমাদেবী: বাংলা সাহিত্যের বিস্মৃতপ্রায় এক নক্ষত্র

By admin

January 08, 2023

বাংলায় একটি বিখ্যাত গান আছে, যার একটি বিখ্যাত লাইন- ‘ঝরে কত তারা আলোকে মনে রাখে বল কে?’ লাইনখানি যে কত সত্যি, তা অনুধাবন করা যায়, বাংলা সাহিত্যের কিছু প্রনম্য কিন্তু বিস্মৃত চরিত্রালোচনা করতে গেলে।তেমনই একটি চরিত্র ‘নিরুপমাদেবী’।বলাই বাহুল্য নামটি সাধারণমানুষ তো বটেই, এমনকি অনেক সাহিত্যপ্রেমী ও সেবীদের কাছেও অজানা।অথচ এমনটি হবার কথা কি? বোধহয় নয়।

বৈশাখের এক নিদারুণ নিদাঘে জন্মেছিলেন নিরুপমাদেবী। ১২৯০ বঙ্গাব্দ।মাতা-যোগমায়াদেবী ও পিতা-নফরচন্দ্র ভট্ট।রক্ষণশীল হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারের কন্যা নিরুপমার যা কিছু শিক্ষা, তা বাড়ীতেই। সময়ের দাবী অনুসারে মাত্র দশবছরে বিবাহ ও শ্বশুরবাড়ি যাত্রা।ধনী পরিবারের কন্যা হলেও বিবাহ হয়েছিল অতি সাধারণ পরিবারে।যদিও দাম্পত্য কী, তা হৃদয়ঙ্গম করবার পূর্বেই সেখানে ইতি ঘটলো।স্বামী নবগোপাল মারা গেলেন যক্ষ্মারোগে। চোদ্দোবছরের নিরুপমার জীবনে বসন্তের পরিবর্তে এলো প্রবল শৈত্য-বৈধব্য।কি ছিল নিরুপমার প্রতিক্রিয়া? নিরুপমার সই অনুরূপাদেবীর চিঠিতে মিললো তার কিছু আভাস “সেই হাস্যময়ী সর্বাভরণ ভূষিতা আদরিনী কিশোরী নয়, সর্ব্বত্যাগিনী শান্তমূর্তি কৃচ্ছ্রবতী বিধবা।”

সারাজীবন এই উপলব্ধিটুকু তাঁর সঙ্গেই ছিল, সাহিত্যের সাধনার মধ্যেই নিরুপমাদেবী সন্ধান পেলেন জীবনের অর্থ।পাশে পেলেন দাদা বিভূতিভূষণকে।এরই মধ্যে ঘটলো এক আশ্চর্য যোগাযোগ। সেই সময় ভাগলপুরে রয়েছেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তাঁকে ঘিরে রয়েছেন সাহিত্যপ্রেমী যুববৃন্দ।তাদেরই একজন বিভূতিভূষণ। সেখানে পৌঁছলেন নিরুপমাও।না, সশরীরে নয়, তাঁর লেখনীর মাধ্যমে। পেলেন শরৎচন্দ্রের আশীর্বানী

‘আরো যাও, আরো যাও দূরে,

থামিও না আপনার সুরে।’

অদ্ভুতভাবে,  এই নিরুপমাদেবীকেই কিন্তু বারংবার তুলনায় পড়তে হয়েছে শরৎচন্দ্রের সঙ্গে।’ভারতী’ তে প্রকাশিত নিরুপমাদেবীর অত্যন্ত জনপ্রিয় উপন্যাস ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’  শরৎচন্দ্রের ‘শুভদা’ থেকে অনুপ্রাণিত, এমন অভিযোগ আনলেন সাহিত্যপ্রেমীরা।অবশ্য এর জন্য নিরুপমার সাহিত্যসাধনায় কোন বিঘ্ন ঘটলো না বরং তার তরী বেশ তরতরিয়েই এগিয়ে গেলো নিজপথে।’মন্দিরা’ গল্পটির জন্য পেলেন ‘কুন্তলীন’ প্রথম পুরষ্কার। ‘প্রবাসী’ তে প্রকাশিত হলো তার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘দিদি’। একে একে আসে ‘শ্যামলী’, ‘বিধিলিপি’ ইত্যাদি।

নিরুপমা কী শুধু সাহিত্য সাধনাতেই নিজেকে আবদ্ধ রেখেছিলেন? না, তিনি একদিকে হয়ে উঠেছিলেন সংসারের সর্বময়ী তেমনি সমাজের দিক থেকেও চোখ ফিরিয়ে নেননি।উদ্যমী হয়েছিলেন স্ত্রী শিক্ষায়।নারী সমিতি গঠনে তাঁর ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সফলভাবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি বালিকা বিদ্যালয়। অংশগ্রহণ করেছিলেন আইন অমান্য আন্দোলনে।বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের কাছে তিনি ছিলেন আদরের ‘মামনি’ এ থেকে বোঝা যায় কতখানি স্নেহশীলা ছিলেন তিনি।

নিরুপমাদেবীর দুটি বিখ্যাত উপন্যাস ‘অন্নপূর্ণার মন্দির ‘ ও ‘শ্যামলী’ র সফল চলচ্চিত্রায়ন হয়েছে।অথচ আজ আমরা কজন মনে রেখেছি তাঁকে?একসময়,  নিরুপমাদেবীকে শরৎচন্দ্রের প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে বিবেচনা করা হতো, সে তাঁদের মধ্যে যে ‘অধরা মাধুরী’ র সম্পর্কই থাক না কেন,আজ শরৎচন্দ্র যদি হন বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র,  নিরুপমাদেবী সেখানে বিস্মৃতপ্রায়। এই অবহেলা, এই বঞ্চনা কি নারী বলেই? প্রশ্ন রয়েই যায়।