ঘুরে-ট্যুরে

এখনো কানে বাজছে ‘দিদি রুখ যাও’

By admin

August 27, 2020

(দ্বিতীয় পর্ব)

ভোর বেলা ঘুম ভাঙলো মেয়ের ডাকাডাকিতে। দেখলাম, হুমড়ি খেয়ে জানলার কাঁচে নাক লাগিয়ে বসে আছে ও। আমি তাকাতেই বললো ,দেখো বাবাই ,কাঞ্চনজঙ্ঘা । বাইরে বেড়িয়ে এসে দেখলাম কৌশিক ছবি তোলায় মগ্ন । সামনে যেন প্রকৃতির চির বিস্ময় স্থির নিশ্চল। সবে সূর্যের রঙ ধরেছে পাকা সোনার মত। বাইরে বেশ ঠান্ডা, চারিদিকে মেঘেদের ভেলারা বাড়ি যাওয়ার তোড়জোড় করছে । তখন চোখ কচলে দেখি ভোর ৫-৩০ বাজে। তবে কি ভাগ্যি তখন তাঁরে দেখেছিলাম, তার কিছুক্ষণ পরেই মেঘ এসে ঢেকে দিল সব কিছু।

সকালের ব্রেকফাস্ট সেরে বীরেনজীর সাথে আমরা চললাম অর্কিড দেখতে। জঙ্গলের পথে পথে কত নাম না জানা গাছের পাতা,ছালের ঔষধি গুনের কথা শুনলাম । একটা ফার্নের পাতা মুড়ে তৈরি হল মেয়ের মুকুট। চারিদিকে অজস্র পাখিদের ডাকাডাকি। আমরা বেশ কিছুটা হেঁটে গেলাম পাহাড়ি জঙ্গলের পথে। কত রকমের অর্কিড গাছ হয়ে রয়েছে আনাচে কানাচে, তাদের নাম, ফুলের বর্ণনা শুনতে শুনতে হঠাৎ বৃষ্টি নামলো ঝমঝমিয়ে। ভাবছিলাম এই রকম অলস দিনযাপন, এই পাহাড়ের কোলে, সঙ্গে সরল মানুষদের মন ছুঁয়ে যাওয়া আতিথেয়তা, এ বারের বেড়ানোর সেরা পাওনা। কথিত আছে, কোন এক ইংরেজ সাহেবের পায়ের চর্ম রোগ কিছুতেই সারছিল না।

এখানের এক ঝর্ণার জলে পা ধুতে ধুতে সেই রোগ সেরে যায়। ঝর্নার জলে কোন খনিজের আধিক্যের কারনেই হয়তো তা সেরে থাকবে। কিন্তু সেই থেকে এখনকার নাম হয় দাওয়াই পানি। জলের কথা বলতে পারবো না,তবে এত নির্মল, দূষণমুক্ত পরিবেশে কয়েকদিন থাকলে শরীর ও মন দুটোই চাঙ্গা হয়ে উঠবে,তা হলফ করে বলতে পারি।সেদিন রাতে ডিনারের মেনু ছিল চিকেন মোমো। এক গামলা মোমো সঙ্গে সস পেয়ে মেয়ে তো আনন্দে আত্মহারা। আমরাও ভাবতে পারি নি চার জনের জন্য অতো মোমো নিজের হাতে বানিয়েছেন সাবিত্রীজি।

ভাবছিলাম এই রকম অলস দিনযাপন, এই পাহাড়ের কোলে, সঙ্গে সরল মানুষদের মন ছুঁয়ে যাওয়া আতিথেয়তা, এ বারের বেড়ানোর সেরা পাওনা।

পরের দিন আমরা শ্যাম দাজুর গাড়ি নিয়ে চললাম লামাহাটা। রাস্তায় খুব বৃষ্টি পেলাম। দেখলাম পাহাড়ের মধ্যে একটা সাজানো গোছানো পার্ক । লামাহাটা ছেড়ে গেলাম তাকদা। শান্ত একটা ছোট্ট শহুরে জনপদ, কয়েকটা দামী রিসর্ট, নানা রঙের অর্কিড দিয়ে সাজানো। সেই ভাবে তেমন কিছু আকর্ষণীয় মনে হল না। ফেরার পথে তিনচুলে ঘুরে দাওয়াই পানি পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গেল। চায়ের কাপ নিয়ে উঠোনের বেঞ্চে বসতে বসতে দেখলাম, দূরে পুরানা বস্তির মন্দিরে কয়েকটা মশালের মত আলো জ্বলছে। শুনলাম সেদিনের সেই বয়স্ক মানুষটি মারা গেছেন,কিছুক্ষণের মধ্যেই বডি এসে পৌঁছাবে। এক আজানা কারনে মনটা ভারী হয়ে উঠলো। মনে পড়ে গেল আত্মার আত্মীয় কথাটা।

পরের দিন ফেরার পালা। কথা মত শ্যাম দাজু আমাদের মিরিক ঘুরিয়ে নিউ জলপাইগুড়ি পৌছে দেবে। সবাই লাগেজ গুছিয়ে গাড়িতে বসলাম। সেদিন বীরেনজীর বছর ছয়েকের ছেলে স্কুলে যায় নি। এই কদিনে তার দিদির সাথে বেশ ভাব হয়েছে। মা বাবার সাথে সেও রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে, হাত নাড়ছে আর আমার মেয়েকে বলছে, দিদি রুখ যাও….

অজান্তেই চোখের পাতা ভারী হয়ে এলো। কথা দিয়েছিলাম, আবার আসবো। সত্যি কেউ কথা রাখে না……..

(শেষ)