থানায় যত মামলা রুজু হয় তার সিংহভাগ মামলা হলো বধূ নির্যাতনের মামলা। যত দিন যাচ্ছে ততো গার্হস্থ্য হিংসা বেড়ে চলেছে। কেন বাড়ছে, কার দোষে বাড়ছে এ নিয়ে সমাজ বিজ্ঞানীরা অনেক আলোকপাত করেছেন। মামলাগুলোতে সমস্যা যতটা না আইনগত, তার থেকে বেশি আবেগ তাড়িত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় সমস্যার মূলে আছে শাশুড়ি বউয়ের ইগো-র সমস্যা। পুলিশি তদন্তে এগুলির প্রতিফলন পাওয়া যায় না। আসলে মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার-স্যাপার প্রমান করা খুব দুষ্কর। আবার তদন্তকারী অফিসারের লক্ষ্য থাকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা বাদীপক্ষ যাতে সুরাহা পান। ব্যাপারটা দুঃখজনক হয়ে দাঁড়ায় যখন গার্হস্থ্য হিংসার কারণে কোনো বধূর মৃত্যু ঘটে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় গৃহবধূরা কত অনায়াসে যেন আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। কিন্তু একটি মেয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছে তার পেছনে কত তাড়না আছে, এটাও গভীর ভাবে ভাবার বিষয়। মারা গেলে সমস্ত প্রেক্ষাপট পাল্টে যায়। সেটাই স্বাভাবিক। এখনো পর্যন্ত আমাদের সমাজে মানুষের জীবনের মূল্য থেকে মূল্যবান কিছু নেই।
এসডিপিও দুর্গাপুর থাকাকালীন 2007 সালে ঘটা একটি বধূ হত্যার ঘটনা আমাকে খুব স্পর্শ করেছিল। বর্ধমান (অধুনা পশ্চিম বর্ধমান) জেলার দুর্গাপুর থানায় NIT অর্থাৎ ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির ক্যাম্পাসের মধ্যে স্টাফ কোয়ার্টারে এক গৃহবধূ আত্মহত্যা করেছিল। বাপের বাড়ির লোকেরা এসে আসামী তথা স্বামীর বাড়ি ভাঙচুর করে। স্বামী, শাশুড়ি ও দেবরকে মারধোর করে। ওদের একটা গাড়ি ছিল তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। তিন জনকে থানায় এরেস্ট করে আনা হয়। আমি কেস তদারক করতে দুর্গাপুর থানায় যাই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করার পর। তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করি। স্বামী জানায় সন্তান হওয়া নিয়ে সমস্যা ছিল। তিন জনকে মারধর করেছে জনগণ। ঠোঁট ফেটে গেছে, রক্ত শুকিয়ে গেছে। শাশুড়ির মধ্যে এক অসহায় মায়ের ছবি দেখতে পেলাম। শাশুড়ির ছোটখাটো ফর্সা চেহারা। উনি বললেন, “ওদের বাবা যখন মারা যায় তখন রূপুর (বড় ছেলে, নাম পরিবর্তিত) বয়স ১২ বছর। তারপর থেকে দুই ছেলেকে বুকে আগলে মানুষ করেছি। স্বামীর চাকরিটা পেয়ে ছিলাম। জিওলজি ডিপার্টমেন্টে, পিয়ন কাম হেলপার। ওর বাবা একটু অবশ্য একটু ভালো পোস্টে ছিলেন। ছেলের বিয়ে দিলাম দেখাশোনা করে। বউয়ের সঙ্গে আমার খিটিমিটি লাগলে, বউ ছেলেকে নালিশ করতো। ছেলে আমাকে বকাবকি করত। কিন্তু বউকে কিছু বলতনা। বলত ডানা না-ফোটা পাখি আনোনি, যে ডানা ছেঁটে পোষ মানাবে। বিএ পাস করা শহরের মেয়ে নিয়ে এসেছ। পোষ মানবে কেন? আমাকে ওরা এসে মারলো। গলার চেইনটা টেনে ছিড়ে দিল। বলল বুড়ির গয়না পরার শখ আছে”। কথাগুলো কেন জানিনা আমায় ভীষণ নাড়া দিল। মায়ের রক্তাক্ত মুখ, অসহায় চাউনি, একটা মেয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যু কে ছাপিয়ে গেল। সে বছর সেপ্টেম্বরে রিটারমেন্ট ছিল মহিলার। শেষ বয়সে চাকরির প্রান্তে এসে এ যে কি শাস্তি। অবসরকালীন সব সুযোগ সুবিধা আটকে গেল।
বলত ডানা না-ফোটা পাখি আনোনি, যে ডানা ছেঁটে পোষ মানাবে। বিএ পাস করা শহরের মেয়ে নিয়ে এসেছ। পোষ মানবে কেন? আমাকে ওরা এসে মারলো। গলার চেইনটা টেনে ছিড়ে দিল। বলল বুড়ির গয়না পরার শখ আছে”। কথাগুলো কেন জানিনা আমায় ভীষণ নাড়া দিল।
আরেকটি ঘটনা মনে পড়ছে, সেটি বীরভূম জেলার রামপুরহাট এর এসডিপিও থাকাকালীন। মারগ্রাম থানায় একটি বধূ হত্যার কেস হয়। সন্তান হওয়া বা না হওয়া ও অন্যান্য কারণ নিয়ে ঝামেলা ছিল। এইসব মানসিক অত্যাচার থেকে পরিত্রান পেতে মেয়েটি গলায় দড়ি দেয়। মেয়েটি তখন অন্তঃসত্ত্বা ছিল। মেয়ের বাবা মায়ের সঙ্গে কথা বলছিলাম। এমনি ই জিজ্ঞাসা করলাম কি বাচ্চা ছিল পেটে। মেয়ের মা দীর্ঘ প্রশ্বাস নিয়ে বলল, “বাবা, আমি ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম পোস্টমর্টেমের সময়, ডাক্তার বাবু বলল ছেলে। বাবা, মেয়েটা একটু ধৈর্য ধরতে পারল না।” বলেই হু হু করে কেঁদে উঠলো মেয়ের মা।
এগুলো সব না বলা কথা।