এক নজরে

#SpecialReport : বার বার নিষেধের খড়্গ নেমেছে নজরুলের গ্রন্থে

By admin

May 25, 2022

১৯২০ সালে নজরুল তাঁর সৈনিক জীবন শেষ করে কলকতায় আসেন। তখন তিনি ২১ বছরের দুর্দমনীয় এক তরুণ। শেরে বাংলা ফজলুল হকের প্রযোজনায় বন্ধু মুজফফর আহমদের সঙ্গে যৌথ সম্পাদনায় নজরুল ‘নবযুগ’ নামে একটি সান্ধ্য দৈনিক শুরু করেন।কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মূলত নজরুলের লেখার জন্য ‘নবযুগ’ রাজরোষে পড়ে। ব্রিটিশ সরকার বেশ কয়েকবার সতর্ক করলেও তিনি কলম বন্ধ করেননি। যদিও সাত মাস পর নজরুল নবযুগ ছেড়ে দেন। যোগ দেন সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘ধুমকেতু’তে; সম্পাদক হিসাবে।

একদিন ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা অফিসে তুমুল আড্ডা চলছে। হঠাৎ দোতলায় ওঠার সিঁড়িতে একসঙ্গে অনেক জুতার শব্দে আড্ডা ভাঙল। নজরুল কলকাতায় ছিলেন না, সমস্তিপুরে গিয়েছিলেন। মুজাফফর আহমেদ বুঝলেন, পুলিশ এসেছে ‘ধূমকেতু’র অফিসে তল্লাসী ও নজরুলের নামে গ্রেফতারের পরওয়ানা নিয়ে। পুলিশ যে সরকারি নোটিশ দেখায় তাতে উল্লেখ ছিল, ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২২ ‘ধূমকেতু’তে প্রকাশিত নজরুলের লেখা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ শীর্ষক কবিতা ও অন্য এক লেখকের ‘বিদ্রোহীর কৈফিয়ৎ’ শীর্ষক একটি ছোট লেখা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। কলকাতায় ফিরে ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা লেখার অপরাধে নজরুল গ্রেফতার হন, জেল খাটেন।

ইতিমধ্যে নবযুগে প্রকাশিত সম্পাদকীয় এবং প্রবন্ধ নিয়ে নজরুল ‘যুগবাণী’নামে প্রবন্ধগ্রন্থ প্রকাশ করেন। ব্রিটিশ শাসকরা নজরুলের এই ‘ঔদ্ধত্য’ বা ‘সাহস’ মেনে নিতে পারেনি।নজরুলের প্রথম গ্রন্থ ‘যুগবাণী’ ফৌজদারি বিধির ৯৯এ ধারানুযায়ী বাজেয়াপ্ত হয়। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে ‘যুগবাণী’কে একটি ভয়ংকর বই হিসেবে চিহ্নিত করে বলা হয়, লেখক বইটির মাধ্যমে উগ্র জাতীয়তাবাদ প্রচার করছেন।‘যুগবাণী ছাড়াও নজরুলের আরও দুটি প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘দুর্দিনের যাত্রী’(১৯২৬) এবং ‘রুদ্রমঙ্গল’(১৯২৬)বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। সরকার এই সব গ্রন্থেখুঁজে পেয়েছিলরাজদ্রোহীতা আর বাংলার মানুষ পেয়েছিল স্বাধীনতার প্রেরণা। ১৯২৪ সালে প্রকাশিত নজরুলের প্রথম নিষিদ্ধ কাব্যগ্রন্থ ‘বিষের বাঁশী’। এর পর পরই নিষিদ্ধ হয় ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থ। বেঙ্গল লাইব্রেরীর লাইব্রেরীয়ান অক্ষয় কুমার দত্তগুপ্ত ‘বিষের বাঁশী’ গ্রন্থটি প্রথম পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) নজরে আনেন। এরপর পুলিশ কমিশনার ‘টেগার্ট’ চীফ সেক্রেটারির কাছে ‘বিষের বাঁশী’সম্পর্কে জানান, “The writer is convicted last year under section 124/A and 153\a I.P.C and sentenced to one year’s R. I. in the dhumketu sedition case. The contents of the Book as would appear in the exacts of translation are dangerously objectionable and I recommend the immediate proscription of the same.” এরপরই চিফ সেক্রেটারি বিজ্ঞপ্তি জারি করেন- ‘বিষের বাঁশী’ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও উত্তেজনা সৃষ্টি করছে। তাই সরকারি দন্ডবিধি ১২৪ এ ধারা অনুসারে বইটি বাজেয়াপ্ত করা হল। এই ঘোষণার পর ব্যাপক খানাতল্লাশি শুরু হয়। কল্লোল অফিস সার্চ হয়। কাল্লোলে ‘বিষের বাঁশী’র অনেক কবিতাছাপা হয়েছিল। যদিও‘বিষের বাঁশীর’ গোপনে বিক্রি ও বিপ্লবীদের হাতে হাতে ফিরতে থাকে। ‘বিষের বাঁশী’ পরপরই বাজেয়াপ্ত করা হয় নজরুলের একই সময় প্রকাশিত আরেকটি কাব্যগ্রন্থ ‘ভাঙ্গার গান’

গত শতাব্দীর তিনের দশকের গোড়ায় ব্রিটিশ সরকারের রোষের কোপে পড়ে নজরুলের আরেকটি কাব্যগ্রন্থ ‘প্রলয় শিখা’। কবির মানসিক অবস্থা তখন খুবই দুঃখজনক। সদ্য মারা গিয়েছে তাঁর প্রিয় পুত্র বুলবুল। ‘প্রলয় শিখা’র প্রতিটি কবিতায় ঝড়ে পড়েছিল কবির চোখের জল আর বুকের আগুন। সেই আগুনের ফুলকি বিদ্যুৎ গতিতে ছড়িয়ে পড়ে গোটা বাংলায়। অবস্থা বেগতিক বুঝে তৎকালীন পাবলিক প্রসিকিউটর রায়বাহাদুর তারকনাথ সাধু ‘প্রলয় শিখা’ সম্পর্কে কলকাতা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডেপুটি কমিশনারকে জানান, বইটি ভারতীয় পেনাল কোডের ১৫৩ এ ও ১২৪ এ ধারা ভঙ্গ করেছে। তাই বইটিকে অবিলম্বে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা দরকার।১৯৩১ সালে বাজেয়াপ্ত করা হয় ‘প্রলয় শিখা’

‘প্রলয় শিখা’র রেশ কাটতে না কাটতে এক মাসের মাথায় নিষেধের খাঁড়া নেমে আসে নজরুলের নজরুলের কাব্যগ্রন্থ ‘চন্দ্রবিন্দু’র ওপর। এই কাব্যগ্রন্থটি মূলত ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের কবিতা। এর প্রতি ছত্রেফুটে উঠেছে তৎকালীন সমাজ ও রাজনীতির প্রতি ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, শ্লেষপূর্ণ হাস্যরস। এটিও ভারতীয় দণ্ডবিধির ৯৯(এ) ধারা অনুসারে বাজেয়াপ্ত করা হয়। এছাড়াও অগ্নিবীণা, ফণিমনসা, সঞ্চিতা, সর্বহারা, রুদ্রমঙ্গল প্রভৃতি বই ব্রিটিশ সরকারের কোপানলে পড়েছিল।