অন্তরমহল

নিসর্গের নতুন স্বরলিপি

By admin

January 18, 2024

আধুনিক কিংবা সমকালীন চিত্রকলায় নিসর্গের অনুধ্যান অথবা প্রকৃতি যে বারবার  অনুসঙ্গ হিসেবে চিত্রপটে ধরা দেয় তা কি কেবলমাত্র চিত্রশিল্পীর সৌন্দর্যবোধ, নাকি  প্রকৃতির মধ্যেই শিল্পী তাঁর আশ্রয় খুঁজে পান অথবা সৌন্দর্যের খনি খুঁজে পান বলে। চিত্রকলায় নানা রূপে ও ভঙ্গিমায় প্রকৃতি কিংবা নিসর্গ ফুটে ওঠা একেবারেই নতুন নয় বরং বলা যায় বেশ পুরনো একই সঙ্গে বহুল ব্যবহৃতও বটে। তা স্বত্বেও চিত্রকলায় নিসর্গের কদর এতটুকু কমেনি।

আমাদের দেশের চিত্রকলায় আধুনিকতা থেকে আধুনিকতাবাদে উত্তরণের পর্বে নিসর্গ বা প্রকৃতি অনেক শিল্পীকেই প্রভাবিত করেছে। নিসর্গ রচনায় অবনীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, বিনোদবিহারী, রামকিঙ্কর প্রমুখের চিত্রকলা বিশ্বদৃষ্টির প্রকাশ ঘটিয়েছিল। প্রসঙ্গত, নিসর্গ চিত্র রচনায় অবনীন্দ্রনাথ এক সময়ে জাপানি শিল্পের প্রকরণ আয়ত্ত করেছিলেন। বিনোদবিহারীর নিসর্গে যে উদাত্ততা ও নির্জনতাবোধ, তার দ্বান্দ্বিক অভিক্ষেপ প্রাচ্যের আধ্যাত্মিকতা অনুপ্রাণিত। রবীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, রামকিঙ্কর তাঁদের নিসর্গ চিত্রে একাধিক আঙ্গিকে তুলে ধরেছিলেন স্বদেশ ও বিশ্বের আধ্যাত্মিক সমন্বয়। এরা সবাই প্রায় মানবিক চৈতন্যের বিনতি দিয়ে প্রকৃতির কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন, বিশ্ব চৈতন্যের সঙ্গে একাত্মতার মধ্য দিয়ে বিশ্বকে অনুধাবনে প্রয়াসী হয়েছিলেন। যে ধ্রুপদী একাত্মতা চিন ও জাপানের নিসর্গ রচনায় লক্ষ্য করা যায়।

সম্প্রতি চিত্রকর প্রদীপ ঘোষের হাল আমলের চিত্রকর্ম দেখতে দেখতে মনে হল, অন্য অনেক শিল্পীর মতো তিনিও প্রকৃতিতে আশ্রয় খুঁজে পেয়েছেন, পেয়েছেন সত্যিকারের সৌন্দর্য। কিন্তু সেটা নিছক উত্তরাধিকারের দূরতর প্রচ্ছায়ার প্রতিফলন কিংবা প্রভাব নয়। প্রাকৃতিক শোভা আত্তীকরণের মধ্য দিয়েই শিল্পী প্রদীপ গড়ে তুলতে চেয়েছেন প্রকাশের নিজস্ব আত্মপরিচয়। আর্ট কলেজের ছাত্র হিসেবে প্রদীপ ভারতীয় চিত্ররীতিতেই প্রশিক্ষিত কিন্তু নিসর্গ রচনায় তিনি সেই আঙ্গিক হবহু অনুসরণ করেননি। বাংলার চিত্ররীতিতে এখনও কতকগুলি নির্দিষ্ট প্রকরণ ও আঙ্গিক-পদ্ধতি লক্ষ্য করা যায় যার মধ্যে সয়াময়িক বা কালচেতনার স্পন্দন থাকে না। তিনি সে পথে না হেঁটে আঙ্গিকের মধ্যে আনতে চেয়েছেন এক অন্য সংশ্লেষ। যদিও নিসর্গের উদাত্ত সৌন্দর্যই তাঁর সন্ধানের বিষয়, তবু আজকের উন্নয়ন ও ছুটে চলার চাপে যে প্রকৃতি ধংসের মুখে, সবুজায়নের নামে যে প্রকৃতি তার সৌন্দর্য ক্রমশই হারিয়ে ফেলছে, প্রদীপের নিসর্গ-রচনা যেন সেই বিপন্ন মানবিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে সোচ্চার, তাঁর আত্মপ্রত্যয়ী উজ্জ্বল অ্যাক্রেলিক ক্যানভাসগুলি যেন সেই প্রকৃতিকে বাঁচানোর তীব্র স্বর।

শিল্পী উজ্জ্বল রঙ ব্যবহারে যেমন তাঁর মুনশিয়ানা তুলে ধরেছেন তেমনই নিসর্গের সব ছবিগুলি হয়ে উঠেছে অনবদ্য।ছবি দেখেই বোঝা যায়, তিনি যেন প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়েই প্রকৃতিকে ছুঁয়েছেন, দেখেছেন, অনুভব করেছেন, তারপর প্রকৃতিকে ক্যানভাসে তুলে এনেছেন তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিমায়। শেষ পর্যন্ত প্রকৃতিলগ্ন থাকতে চেয়েছেন বলেই ঘুরেফিরে তাঁর ক্যানভাসে ফুটে উঠেছে নিসর্গের রূপমাধুরী। উজ্জ্বল রঙ ব্যবহার করলেও অত্যন্ত পরিশীলিত ও মার্জিত অবস্থানে প্রকৃতির মধ্যে বিরাজমান রংটাই তুলে আনতে পেরেছেন। এ ছাড়া অতি সূক্ষ্ম আলো-ছায়ার ব্যবহারেও তাঁর মুনশিয়ানা ফুটে ওঠে। প্রদীপের নিসর্গ ক্যানভাস প্রকৃতি দেখারও নতুন স্বরলিপি।