এক নজরে

আমার বেনারস

By admin

December 19, 2023

কোলে ক’রে নয়, আমার একটা হাত ধরে আমার বাবা আমায় বেনারসের সব মন্দির ঘুরিয়েছিলেন। তখন আমি খুবই ছোট কিন্তু মনে আছে দশাশ্মমেধ ঘাটে এসে গোলগাপ্পা খেয়েছিলাম, কচৌরি গল্লি থেকে কচুরি, ক্ষীরসাগর্ থেকে রাবড়ি আর বিশ্বনাথ গলির প্যাঁরা। ওই গলির জর্দা পৃথিবী বিখ্যাত। মদনপুরায় বেনারসী শাড়ির তাঁত বুনছে বারো কি চোদ্দ বছরের মুসলিম বাচ্চারা। তারা লেখাপড়া করে না, বা করলেও হালকা মাদ্রাসায় পড়ে কিন্তু ওই ছোটছোট আঙুলে অপূর্ব জড়ির কাজ করে। পাঁড়েহোলির গলি (পান্ডে হাভেলি) দিয়ে সটান গেলে আরও সরু গলি তারই মাঝে ছোট্ট একটা হনুমানের বিগ্রহ আছে- ক্ষুদে মন্দির, ওইখানেই খুন হয়েছিলেন জয়বাবা ফেলুনাথের মৃৎশিল্গী। উফ্ কী এক রোমাঞ্চে আমার ওয়ান সি সি ডি ক্যামেরা ( চালাতে তেমন পারিনা) তাতে কি ক্যামেরা মাথায় খেলে গেল জার্ক করাতে হবে। কারণ ওই খুনের দৃশ্যে ক্যামেরা জুম করেছিলেন shake করতে করতে; সৌমেন্দু রায় -সত্যজিতের ক্যামেরাম্যান। এর পরে দু’ঘন্টা ওই শট-টা নেবার পরে কথা বলিনি কারুর সঙ্গে, মনে হচ্ছে ঘাড়ের কাছে কে এসে ডাকলো, “পেলব”… আমার বাবা আমাকে ডাকছেন। নাহ্, বাবা নয়, ওটা একটা হ্যালুসিনেশন।

আবার টানছে বারাণসী৷ এ এক অদ্ভুত অমোঘ টান৷ ভারতবর্ষকে দেখতে হলে, তেমন ভাবে জানতে হলে, যে সব জায়গায় না গেলে দেখা-জানা অসম্পূর্ণ থেকে যায়, বারাণসী তার অন্যতম৷ যাওয়া মানে কেবলমাত্র যাওয়া নয়, দেখবার চোখ, জানতে চাওয়ার মন নিয়ে যাওয়া৷ শেষবার গিয়েছিলাম ২০১৭-তে, এপ্রিলের প্রথম দিকে৷ সেবারে তো একদিন থেকেছিলাম। ২০১৬-তেও গিয়েছিলাম। বেজায় গরম পড়ে গেছে তখন, এপ্রিলের দিনের বেলা ৪২-৪৩ ডিগ্রি৷ তার মধ্যেই একটা টোটো নিয়ে টৈ টৈ করে ঘোরা- ভোর পাঁচটা থেকে শুরু, দুপুরে হয়ত একটু বিরতি, তারপর আবার রাত অব্দি৷ আর অন্তহীন ছবি তোলা৷

ছবি তুলতে গেলে বারাণসীর পথ, ঘাট, অলিগলি তো স্বর্গরাজ্য! A mutation of colour! আজ হঠাৎ সেই সব ছবির ঝাঁপি খুলেছিলাম, তার থেকে কয়েকটা৷ আসলে এই সব ছবি আবার দেখা, নিজেকে চাগিয়ে তোলার জন্য৷ আবার বারাণসী টানছে যে! এই বারাণসী আমরা জানি, সত্যজিত রায়ের প্রিয়। কিন্তু অসভ্য, অশিক্ষিত, বর্বর এক দল লোক বারাণসীর ইতিহাস ঐতিহ্যকে চুরমার করে অনেকটাই ধ্বংসের পথে নিয়ে গিয়েছে। আমাদের সন্ততিরা সেই বারাণসী দেখতে পাবে না আর। যার আমি নাম দিয়েছিলাম a city of “time past in time present”।

বারাণসী নাম শুনলেই এঁদের কথাই মনে আসে। কি জানি কেন। ছবিগুলি সুন্দর, পূণ্য, ভক্ত, আরতি, গঙ্গা, মন্দির। এঁরা আবহমানকাল ধরে গঙ্গার পারে অপেক্ষা করেন, শুধুমাত্র ভালোয় ভালোয় ভব সাগর পার হবার আশায়। কি বিশ্বাসে জানিনা।”ভারতবর্ষ, আমার শৈশবের শিশুশয্যা, যৌবনের বৃন্দাবন, বৃদ্ধবয়সের বারানসী”- বিবেকানন্দ।এইসব স্মৃতি অনেকেরই। ছবিতে যে কথা বলা নেই-  ঘাটগুলো বরাবর গঙ্গার ধার দিয়ে একা একা হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, মাথায় রোদ্দুর তখন ঝলসে দিচ্ছে, তাপমাত্রা যে কত সে ব্যাপারে আমার হুঁশ নেই, ছাতা নেই, মাথায় একটা গামছা জড়িয়ে রেখেছি, বুক ভর্তি তেষ্টা,জলের বোতলে জল শেষ। সে সময় তোলা ছবিগুলির একটা ঐ ছবি। বেলা একটা নাগাদ যখন আমাদের আরামের আস্তানায় ফিরলাম, আমার মামাবাড়ি- আমার প্রিয় বন্ধু আমার মাইমা দরজা খুলেই প্রথম যা বললেন, তা হল, “তুই কি পাগল! জানিস, বাইরে এখন টেম্পারেচার কত? ৪৩ ডিগ্রি দেখাচ্ছে!”

ছবি তোলার জন্যই তো বারাণসী যাওয়া। ছবিতে যে কথা বলা নেই- ঘাটগুলো বরাবর গঙ্গার ধার দিয়ে একা একা হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, মাথায় রোদ্দুর তখন ঝলসে দিচ্ছে, তাপমাত্রা যে কত সে ব্যাপারে আমার হুঁশ ছিল না, ছাতা নেই (থাকলে ছবি তোলা মুস্কিল), মাথায় একটা গামছা জড়িয়ে রেখেছি, বুক ভর্তি তেষ্টা, জলের বোতলে জল শেষ। সে সময় তোলা ছবিগুলির একটা ওই ছবি। বেলা একটা নাগাদ যখন সোনালী আলোয় মায়াময় তখন বারাণসী ফটোগ্রাফির স্বর্গরাজ্য। 

চলবে…