এক নজরে

আমার বেনারস

By admin

December 20, 2023

(গতকালের পর)

বেনারস গেলে আমি আমার বাবাকে খুঁজে পাই। বারবার। আমার নাস্তিক বাবাই আমাকে অত শিশু বয়সে বাম হাতের কচি কনিষ্ঠাঙ্গুলটি ধরে আস্তিক বেনারস চিনিয়েছেন। আমার স্মৃতিতে দ্বিতীয় আর একটাও মানুষকে পেলাম না সেই যত্ন, সেই আশ্চর্য আলগা ভাব!

গোধূলিয়ার মোড়- চূড়ান্ত বাজে ট্রাফিক ব্যবস্থা, একটা ঘোড়াশাল আর এক্কাগাড়ি। উনভারসিটি কেতনা লেবা? বিশ। চলিয়ে। দূর্গা মন্দির, ভেলুপুরা, সোনারপুরা, লঙ্কা হয়ে ইউনিভার্সিটি। বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির আর্ট কলেজের প্রতিষ্ঠাতা আমার ছোট মামীর বাবা পশুপতিনাথ মুখোপাধ্যায়। বিএইচইউর প্রতিষ্ঠাতা মদন মোহন মালব্যের স্ট্যাচু ও ধর্মপালের সব স্ট্যাচুই পশুপতিনাথের শিল্পকান্ড। ওঁর বাড়ির নাম শিলা তুলি, এখন ‌আমার ছোটমামার সংসার। ওখানে বাঙালিটোলা স্কুলের ঠিক পাশের বাড়ি, তিনতলা বাড়ি। গোটা ‌বাড়িটাই মিউজিয়াম।

বড়ো নস্ট্যালজিক। মন কেমন করাটাও থাকুক, এই মন কেমন করাটাই তো চাই, এটার জন্যই তো দৌড়াই বেনারস। মনিকর্ণিকা ঘাটের চিতা কখনো নেভে না। অনন্ত কাল সে আগুন জ্বলেই চলেছে। অদ্ভুত। পাঁড়ে ঘাটের গোয়ালা‌পাঁড়ে বলে ওখানে ওদের কুস্তির আখড়া, পাশেই‌ চৌষট্টি ঘাট। ওখানকার ভাষায় চোসট্টি ঘাট। সেখানেই সর্বজয়া ডেকে দেওয়াতে কমন্ডুল নিয়ে শিশু অপু ঘুম চোখ কচলাতে কচলাতে গঙ্গা থেকে জল আনলো, হরিহরের গলায় জল ঢেলে দিল, হরিহরের মুখটা‌ ফ্রিজ হয়ে গেল- জাম্পকাট (jump cut), ঘাটে বসা এক ঝাঁক পায়রা উড়ে গেল চেনা জায়গা ছেড়ে চরাচরে। সত্যজিতের ‘অপরাজিত’। ছবিটির এই দৃশ্যটা মনে পড়ে? চোখ ছলছল করে না? নিদারুণ দারিদ্র আর কী যে অপমান জীবনে, তাই কতো যে অভিমান! সত্যজিতের চিত্রভাষায় বেনারস। লাক্সা ছাড়িয়ে যাবার‍ পর যাওয়া হলো কিষেন মহারাজের বাড়ি।

কিষেন মহারাজ ছিলেন কন্ঠে মহারাজের পুত্র। অসাধারণ তার বাজনা! কন্ঠে মহারাজের তবলা- সেও এক আশ্চর্য্য ব্যাপার। ধিন/ধি: গে এবং দিন্-এর একত্র প্রয়োগে রে ধ্বনি। ধেং- গে এবং দিং-এর একত্র প্রয়োগে এই ধ্বনি উৎপন্ন হয়। তিন্: কে এবং দিনধ্-এর একত্র প্রয়োগে এই ধ্বনি। উৎ ধিং: গে এবং দিং-এর একত্র প্রয়োগে এই ধ্বনি। ধেৎ: গি এবং তেৎ-এর একত্র প্রয়োগে এই ধ্বনি উৎপন্ন হয়। তবলা বাজিয়ে গণেশ পূজো করেন কিষেণ মহারাজ। একদিকে সানাই বাদক বিসমিল্লা খাঁ আর তবলিয়া কিষেণ মহারাজ।

দসেরার দিন (বিজয়া দশমীতে) দশাশ্মমেধ ঘাটে খোলা অনুষ্ঠান। অপেক্ষা করছেন রবিশঙ্কর আর তার সাথে তবলিয়া আশু ভট্টাচার্য্য (কবিরাজ)। আশু কবিরাজের প্রত্যহ অভ্যাস খুব ভোরবেলায় রেওয়াজ, সকালে কবিরাজি, সন্ধ্যে বেলায় আবার রেওয়াজ। গুরু কন্ঠে মহারাজ আশু ভট্টাচার্য্যকে প্রতিঙ্গা করিয়েছিলেন, ওয়াদা ‌করো, কভ্ভি মাচা পর্ মত আও। সেই থেকে মহৎ মহাঋষির কাছে দেওয়া ওয়াচন ভঙ্গ হয়নি। তিনি পয়সা নিয়ে প্রোগ্রাম করতেন না। কিন্তু যিনি জুহুরী সেই রবিশঙ্কর কিন্তু জানেন তার সেতারের ঝঙ্কারে উনি যখন রাগ শঙ্করভরণম্ বাজাবেন সেই স্পেশাল পৌনে চার তাল আর কেউ পারবে না আশু কবিরাজ ছাড়া।

একবার আমার খুব জন্ডিস হয়েছিল। খুউব। বাঁচবো না-ই এরকম শুনছিলাম। বাবা নিয়ে এলেন বেনারসে। দেখাতে গেলেন আমাকে আশু কবিরাজের কাছে নিয়ে গিয়ে। তখন খুব ছোট নই, বয়স আমার পঁচিশ, পাকামি করে বললাম, আমার অসুখ congenital ideopathic unconjugated hyper bilirubinimiea. উনি বললেন, চুপ! একেবারে চুপ করো। এই টেস্ট, ওই টেস্ট, সেই টেস্ট, তাই টেস্ট-এর গল্প খালি? চুপ্, কোনও কথা নয়। আমি থমকে গেলাম। বললেন, এতসব টেস্ট করবে না‌, আমার ওষুধ খাও। আর তবলা শোনো। শুনবে? একট ব্ল্যাঙ্ক ক্যাসেট নিয়ে এসো কাল, আমি‌ রেকর্ডিং করে দেবো। ওটা রোজ শুনো। আর কে বলেছে তুমি অসুস্থ? তুমি ভাল হয়ে যাবে। গীরিজা দেবীর একটা গান হাল্কা করে কোথাও বাজছিল, আর আশু কবিরাজ মাঝেমাঝেই আমাকে দেখছেন, কথা‌ বলছেন আর আনমনে টেবিল বাজাচ্ছেন, তার সোম্‌ আর মুখ কী অদ্ভুত ক্যালকুলেটিভ। এক অসাধারণ দর্শনীয় স্মৃতি।

চলবে…