এক নজরে

রাত ভোর থেকে আকালের সন্ধানে

By admin

May 14, 2023

কান চলচ্চিত্র উৎসব; ১৯৮২। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের সঙ্গে মৃণাল সেনের প্রথম আলাপ। দুজনেই উৎসবে জুরি হয়ে গিয়েছিলেন। সেই আলাপ দ্রুত বন্ধুত্বে পরিণত হয়। এর বছর দুই-তিন পর হাভানাতে ফের দেখা হয় দু’জনের। সেখানে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, দেশ বিদেশের ছবি, সাহিত্য থেকে কীভাবে চলচ্চিত্র নির্মান করা যায় এসব নিয়ে প্রচুর কথা হয় দুইবন্ধুর।

এমন একটা প্রস্তাব মৃণাল ফিরিয়ে দিলেন কেন? মৃণাল সেনের বক্তব্য অনুযায়ী, আসলে মার্কেজ মৃণালের কাছে একটা ভারতীয় যোগাযোগের সূত্র খুঁজছিলেন। কিন্তু মার্কেজ বোঝার চেষ্টাই করেননি যে ওই গল্প নিয়ে ছবি করা মৃণাল সেনের পক্ষে অসম্ভব কাজ। মার্কেজ জানিয়েছিলেন, ছোটদের কোনো একটা বইতে তিনি একটা ভারতীয় বাড়ির ছবি দেখেছিলেন। সেই ছবিটিকে মাথায় রেখেই এই গল্পটি লিখেছিলেন। মৃণাল মার্কেজকে বলেছিলেন, ওই গল্পের সমাজ, চরিত্র থেকে শুরু করে সব কিছুই এত বেশি লাতিন আমেরিকান যে তার মেজাজ বদলে ভারতীয় প্রেক্ষেপটে নিয়ে আসা দুরূহ কাজ। মার্কেজ মৃণালের বক্তব্য বুঝতে পেরেছিলেন। তাঁর ছবির দর্শকও জানেন মৃণাল সেন ঠিক কোন মেজাজের চলচ্চিত্র নির্মাতা।

১৯৫৫ সালে মৃণাল সেনের প্রথম ছবি ‘রাত ভোর’। ওই বছরই সত্যজিৎ রায় তোলেন ‘পথের পাঁচালি’। ‘পথের পাঁচালি’ গোটাসিনেমা দুনিয়ায় সাড়া ফেলল, কিন্তু মৃণাল সেনের প্রথম ছবি সে অর্থে কোনও দাগ কাটতে পারলো না। আপ্রাণ চেষ্টা করে আরও একটি ছবি করলেন বটে তবে নিজেকে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসাবে চিহ্নিত করতে লাগলো প্রায় বছর পাঁচ।তৃতীয় ছবি ‘বাইশে শ্রাবণ’-এ তিনি নিজেকে কিছুটা হলেও চেনাতে পারলেন।

মৃণাল সেনের ‘ভুবন সোম’ ছবিটি অনেকের মতে তাঁর শ্রেষ্ঠ ছবি। এরপরই মৃণাল তাঁর কলকাতা ট্রিলোজি অর্থাৎ ‘ইন্টারভিউ’(১৯৭১), কলকাতা ৭১’(১৯৭২) এবং ‘পদাতিক’(১৯৭৩) নির্মান করেন। তিনটি ছবিতেই তিনি সত্তর দশকের কলকাতার অস্থির সময়কে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। কি বলতে চেয়েছেন মৃণাল? তিনি কি কলকাতার রাজনীতির মনোস্তত্ত্বে প্রবেশ করতে চাইছিলেন, নাকি সেকালের তরুণদের চোখ দিয়ে কলকাতার রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। তবে ‘ইন্টারভিউ’ ছবিটিতে আমরা যেন আরও একবার ‘পথের পাঁচালী’-র সর্বজয়া, অপু ও দুর্গাকে পেয়েছি। রঞ্জিত, তাঁর মা ও বোন। যদিও মৃণালের কথা অনুযায়ী কোলোনিয়াল লিগ্যাসি থেকেই গিয়েছে, এবং সেটা কেবল পোশাকের স্তরে নয়, সর্বস্তরে কাজ করেছে। আর সেটা দেখাতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত একটা কোলাজের মতো করে নানা ধরণের মন্তব্য, একটা ক্ষীন গল্পের বাইরে গিয়ে ফের দরকার মতো ভিতরে এসে একটা গল্প বলার চেষ্টা, মন্তব্য, বক্তব্য…।

তাঁর সিনেমায় কেবল ক্ষোভ নয়, একের পর এক ছবিতে তিনি ফিরে গিয়েছেন দুর্ভিক্ষের বিভীষিকাময় প্রেক্ষিতে। শুধু ১৯৪৩-এর মন্বন্তর নয়, উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতে যে মর্মান্তিক খাদ্যসঙ্কট তৈরি হয়েছিল ষাট আর সত্তরের দশকে- ‘বাইশে শ্রাবণ’, ‘কলকাতা ৭১’, ‘মাটির মনিষ’, ‘আকালের সন্ধানে’-র মতো ছবি তো তেমনটাই বলে। হয়ত তিনি ভাবতেন, ক্ষুধাই পারে মধ্যবিত্তকে তার নিশ্চিন্ত গৃহকোণ থেকে তীব্র ক্ষোভের রাজনীতিতে টেনে আনে।

লক্ষ্যনীয় মৃণাল সেনের ‘আকালের সন্ধানে’র(১৯৮০)আগেই সত্যজিৎ রায় বানিয়েছেন ‘অশনি সংকেত’(১৯৭৩)।অন্যদিকে ১৯৭২-এ মৃণাল সেন বানান ‘কলকাতা ৭১’। ‘অশনি সংকেত’ বিভূতিভূষণের উপন্যাস অবলম্বনে, ‘কলকাতা ৭১’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবোধ স্যান্নাল, সমরেশ বসু এবং অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প থেকে করা চিত্রনাট্য।

সিনেমা নির্মাণের দিক থেকে সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’ সোজা সাপটা ভঙ্গিতে মানবিক সংকটের আখ্যান। অন্যদিকে ‘কলকাতা ৭১’ একটু জটিল। আসলে সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতির হিসাবটা এক রৈখিক নয়। অসহায় মানুষগুলো সদা এক জটিল রাজনীতি, অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ অতটা সরলরেখায় হয় না, সেগুলি নানা আবর্তে পাক খেতে থাকে। মৃণাল সেন পুঁজিবাদ, শ্রেণী শোষণ ও সামাজিক অসঙ্গতিকে চারটি ভিন্ন ভিন্ন গল্পে বুনলেও তা সোজা সরল নয়।

মৃণাল ১৯৮০-তে দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে যে ‘আকালের সন্ধানে’ করলেন তাতেও কিন্তু কেবল দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তর নয়, অন্য অনুভব যোগ করলেন। গ্রামীণ সমাজের সারল্য, অজ্ঞতা, নারীর অবমূল্যায়ন, শহর ও গ্রাম জীবনের ফারাক- এমনই সব বিষয় উঠে আসে একটি সিনেমার শুটিংয়ের অজুহাতে। শহর আর গ্রাম যে দুটো আলাদা পৃথিবী, জীবন আর সিনেমার বাস্তবতা যে এক নয় মৃণাল সেন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। ১৯৪৩ আর ১৯৮০, ইতিহাস আর বাস্তব একাকার হয়ে যায়। জীবন আর সিনেমার ফারাক বেরিয়ে আসে।

মৃণাল তাঁর ছবিতে নিরলস চেষ্টা করেছেন শাসক ও মধ্যবিত্ত সমাজের কাঠামো খুলে দেখাতে। হয়ত অনেক সময় তা নান্দনিক হয়ে ওঠেনি। তবে অভিঘাত বেশ তীব্র, যা শেষে আমাদের অনেক কঠিন প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছে, বিপন্ন করেছে।তুলনায় সত্যজিৎ নিখুঁতভাবে গল্প বুনে গিয়েছেন, চেষ্টা করেছেন নিরপেক্ষ থাকতে। যেমন সত্যজিতের ‘অশনি সংকেত’ সেই তেতাল্লিশের আকালেরই ছবি, কিন্তু দুজনের চিত্রভাবনা সম্পূর্ণ আলাদা। ‘অশনি সংকেতের’ আকাল অতীত ‘ইতিহাস’, মন্বন্তরের প্রেক্ষাপটে এক সাধারণ পরিবারের বেঁচে থাকার লড়াইয়ের গল্প, তার সঙ্গে বর্তমানের কোনো যোগাযোগ নেই।

‘অশনি সংকেত’ আমাদের বিষন্ন করে, কিন্তু ‘আকালের সন্ধানে’ দেখতে আমরা বিব্রত বোধ করি। রাজনীতি-সমাজ-অর্থনীতির তর্কাতর্কিতে মৃণালের হাত ধরে আমরা আধুনিক থেকে উত্তর আধুনিকতায় পৌঁছে যাই। বুঝতে পারি তাঁর ছবি একমাত্রিক নয়, বহু অলিন্দ ধরে তিনি হেঁটেছেন সেলুলয়েডে। কখনো সরাসরি আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন, বলতে চেয়েছেন এটা চলচ্চিত্র বা সেরকম কোনও মাধ্যম নয়, তাহলে সেটা কি? হতে পারে চলচ্চিত্রের রূপরেখা কিংবা নীল আকাশের নীচে একদিন প্রতিদিন অথবা তার সব কিছু খারিজ করে দিয়ে একদিন আচানক খণ্ডহরে পৌঁছে যাওয়া।