প্রবাসীর ডাইরি

দুই আর দুইয়ে চার মেলেনা সেখানে

By admin

July 23, 2020

মোজাম্বিক-প্রথম পর্ব

লেখা ও ছবি-নিলয় রঞ্জন দত্ত

জঙ্গল ঘেরা গ্রামের কোন খানটায় ছাউনি পড়বে তা নির্দিষ্ট করে দিলো গ্রামবাসীরাই। বিপদ সেখানে পায়ে পায়ে। আফ্রিকার স্থানীয় জনজাতির মানুষ আশৈশব তাদের অভিজ্ঞতার কারণেই হয়তো বিপদের খানিকটা হলেও আগাম আঁচ পায়। কিন্তু আমরা সেখানে আনাড়ি। কলকাতার ছেলে। বেড়েও উঠেছি যোধপুর পার্কের অবস্থাসম্পন্ন পরিবারেই। মোজাম্বিকের পরিবেশ সম্পর্কে আমার অন্তত কোনো ধারণা ছিল না। যে জায়গাটায় ছাউনি পড়বে সেই জায়গাটা সাফ করা হলো। সেখানেই দাঁড়ালো আমাদের তিনটে গাড়ি। গাড়ি মানে সামনের দিকটা জিপের মতো, পেছনের দিকটা ট্রাকের মতো দেখতে। জঙ্গল এলাকা। সেখানে মাটিতে তাঁবু খাটানোর অনুমতি নেই। ফ্লোটিং টেন্ট খাটাতে হতো গাড়ির ওপরেই।বহুজাতিক সংস্থার জিওলজিক্যাল এক্সপ্লোরাশনের কাজ শুরু হবে আফ্রিকার দক্ষিণ প্রান্তের পূর্ব উপকূলের দেশ মোজাম্বিকের ওই অঞ্চলে। রাজধানী শহর মাপুটো হলেও আমরা নেমেছিলাম টেট প্রদেশের মূল শহর টেটেই। সেটাই নিকটতম বিমানবন্দর। উত্তর-মধ্য মোজাম্বিকের যে এলাকাতে আমাদের কাজ চলবে অন্তত মাস কয়েক, টেট শহর থেকে তার দূরত্ব ২৩০ কিলোমিটার। কলকাতার ছেলে। ভাবলাম, এ আর এমন কি দূরত্ব! এ তো বড়জোর কলকাতা থেকে আসানসোল। আসানসোল কিংবা কলকাতার অনেক মানুষই ওই পথে ডেইলি পাসেঞ্জারি করে। কিন্তু দেখলাম সে পথ পেরোতে শুধু যে সাত ঘন্টা লাগে তাই নয়, সে পথ পাড়ি দেওয়াও এক বিরাট ঝকমারির।

প্রথম ৪০ কিলোমিটার রাস্তা বেশ মসৃণ। কলকাতা-দিঘা কিংবা কলকাতা-ডায়মন্ড হারবার যাবার রাস্তার মতোই। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে যদি বা নাও হয়। কিন্তু তারপর? একশো বছরেরও আগে মোজাম্বিকের বন্দরগুলোর সঙ্গে রেল যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল পার্শ্ববর্তী দেশ মালাবি কিংবা জিম্বাবুয়ের মতো দেশগুলির সঙ্গে। কারণ তাদের কোনো সমুদ্র বন্দর নেই। কিন্তু মোজাম্বিকের গৃহযুদ্ধে আক্রমণের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেই রেল ট্র্যাকগুলোই। মুহুর্মুহু বোমাবর্ষনে বিধস্ত হয় রেল যোগাযোগ। সেই রেলপথে তখন কোনো রেল চলতো না। রেল লাইনের সমান্তরালে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ছিল এক রাস্তা। সে পথেই চলতো গাড়ি। সে পথেও পেরোতে হতো ঘন্টা চারেক। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যাও হাতে গোনা। ছয় ঘন্টায় হয়তো যাতায়াত করে বড়জোর দশটি গাড়ি।কিন্তু ঘন্টা দেড়েকের শেষ পথটাই ছিল সবচেয়ে বিপদজনক। আফ্রিকার ঘন জঙ্গল। জঙ্গলের মধ্যে সেভাবে কোনো রাস্তা নেই। গন্তব্যে পৌঁছাতে গুগল ম্যাপই ভরসা।যেতে যেতেই জঙ্গলের মাঝে ছোট্ট ছোট্ট জনবসতিগুলোতে খেয়াল করছিলাম একটা অদ্ভুত দৃশ্য। মাটির বাড়ির দেওয়ালে ছাই দিয়ে আঁকা নানা মোটিফ। অনেকটা আলপনার মতো ঠেকে। ওগুলো কি ? সঙ্গে থাকা দোভাষী জানালো, অশুভ আত্মাকে দূরে সরিয়ে রাখতে এটাই এখানকার রেওয়াজ। মনে পড়লো, দার্জিলিং, সিকিম, নেপাল কিংবা তিব্বতের কথা। সেখানেও বাড়ির বাইরে রং-বেরঙের কাপড়ের নিশানা টাঙিয়ে রাখে স্থানীয় মানুষেরা। কথায় কথায় সেই দোভাষীই জানালো, আফ্রিকার সিংহ তো আছেই, আমরা যে এলাকাতে কাজ করব তা বিশেষ ভাবে পরিচিত ব্ল্যাক মাম্বার জন্য। ব্ল্যাক মাম্বা? সে তো দুনিয়ার ভয়ঙ্করতম সাপেদের একটি প্রজাতি। আমার মতো আমাদের প্রজন্মের অনেকেরই আফ্রিকা সম্পর্কে প্রথম পাঠ বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যারের ‘ চাঁদের পাহাড়’ পড়েই। সে দুপুরে মনে করার চেষ্টা করলাম শঙ্করের সেই ব্ল্যাক মাম্বার মুখামুখি হওয়ার দৃশ্যটা। মনে করে শরীরটা যেন কেমন হিম হয়ে গেল।

জায়গাটা প্রাদেশিক মূল শহর থেকে ২৩০ কিলোমিটার দূরে হলেও পৌঁছে বুঝলাম, জীবনযাপনটা সেখানে মোটেই সহজ নয়। পানীয় জল?আনতে যেতে হবে গাড়িতে ঘন্টা খানেকের পথ পেরিয়ে। নিকটতম স্বাস্থ্য কেন্দ্র? তাও গাড়িতে ঘন্টা দেড়েকের পথ। বাজার হাট? ঘন্টা সাতেক দূরে টেট শহরই ভরসা। জেলা সদর ? সেও ঘন্টা আটকের পথ। সকাল ছটায় বেরোলে পৌঁছানো যায় অন্তত বেলা তিনটে নাগাদ। দুই আর দুইয়ে চার মেলেনা সেখানে। তা জেনেই শুরু হলো অজানা পথে পথ চলা।

চলবে…