এক নজরে

ঈশ্বরের মা

By admin

March 28, 2023

ভারতবর্ষ মহাপুরুষদের লীলাক্ষেত্র নামে পরিচিত। যুগে যুগে এমন সব মহামানবরা এখানে জন্ম নিয়েছেন যাঁরা সভ্যতার অগ্রগতিতে সবচেয়ে অগ্রনী ভূমিকা নিয়েছেন।বাংলা এর মধ্যে অন্যতম পীঠস্থান। উনিশ শতকে নবজাগরণে যাঁরা ছিলেন অগ্রনী তাঁদের অনেকেরই জন্মভূমি তথা কর্মভূমি এই বাংলা। বাংলার মায়েরা সত্যিই রত্নগর্ভা। তেমনই একজন রত্নগর্ভা ভগবতীদেবী। সেইসময় মেয়েদের প্রথাগত শিক্ষার প্রচলন না থাকায় ভগবতীদেবী তথাকথিত শিক্ষালাভের সুযোগ পাননি, কিন্তু তাঁর মানবিক গুনাবলীর অভাব ছিল না। তিনি অত্যন্ত তেজস্বী একইসঙ্গে দয়াময়ী ছিলেন। তাঁর ব্যবহারে কোনরূপ অহঙ্কারের স্পর্শ ছিল না।

ন’বছর বয়সে বীরসিংহ নিবাসী ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিয়ের পর তিনি মাতুলালয় থেকে স্বামীগৃহে আসেন। নিজের গুণে অচিরেই তিনি সংসারে সকলের মনে জায়গা করে নেন। শত দারিদ্রের মধ্যেও তাঁর মুখের হাসিটি সবসময় বজায় থাকত। নিজের দুঃখ কষ্ট দারিদ্রের কথা কখনো বাইরের লোকের কাছে প্রকাশ করতেন না।এরপর দরিদ্র ঠাকুরদাসের পর্ণকুটীরে শিশুপুত্র ভূমিষ্ঠ হয়। ঠাকুরদাস শিশুর নাম রাখেন ঈশ্বর। ছোট্ট ঈশ্বর মায়ের কাছ থেকে জন্মসূত্রেই লাভ করেন তাঁর তেজস্বীতা, দয়া প্রভৃতি মানবিক গুণ।

বিদ্যাসাগরের মা ভগবতীদেবী- এটাই তাঁরএকমাত্র পরিচয় নয়। তারও চেয়ে অনেক বেশি আখ্যান জড়িয়ে আছে এই মানবীর জীবনে। বিদ্যাসাগরের প্রধান কীর্তি বিধবা বিবাহ প্রবর্তনেও রয়েছে তাঁর মায়ের অনুপ্রেরণা। বিনয় ঘোষ লিখেছেন- ‘বালবৈধব্যের দুঃখ কষ্টে কাতর হয়ে একবার নাকি ভগবতীদেবী ঈশ্বরচন্দ্রকে বলেছিলেন ‘তোদের শাস্ত্রে কি এমন বিধান নেই কোথাও, যাতে এই দুঃসহ জীবনের অবসান ঘটানো যায়?’ মায়ের কথায় উৎসাহিত হয়ে ঈশ্বরচন্দ্র শাস্ত্র ঘেঁটে বিধবাবিবাহ অশাস্ত্রীয় নয় প্রমান করবার জন্য নাকি তৎপর হয়েছিলেন।”

গ্রামে অবৈতনিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা বা দুর্ভিক্ষে মানুষকে অন্নদান-সবেতেই ছিল বিদ্যাসাগরের দরদী জননী ভগবতীদেবীর ঐকান্তিক ইচ্ছা। বিধবাবিবাহ প্রবর্তন করতে গিয়ে নানান বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন বিদ্যাসাগর, তার প্রভাব এসে পড়েছিল বীরসিংহ গ্রামেও। বিরোধীপক্ষের লোকজন প্রায়ই নানান ভাবে অত্যাচার চালাতো বিদ্যাসাগরের পরিবারের উপর।সবই নীরবে সহ্য করতেন ভগবতীদেবী। ক্ষমাই যে পরমধর্ম।তাই সবই তিনি প্রফুল্লচিত্তে সহ্য করতেন। তাঁর এই প্রফুল্লতা অন্যদের চিত্তকেও স্পর্শ করে, তাদের মনকে জাগিয়ে তুলতো।

প্রচণ্ড দারিদ্রের মধ্যেও ভগবতীর গয়নাগাটির দিকে ঝোঁক ছিল ভালই। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে সব যেন হঠাৎই উধাও হয়ে যায়। তখন বাড়ির মেয়ে, বউদেরও গয়না নিয়েও আদিখ্যেতাও তিনি মোটেও পছন্দ করতেন না।একবার বিদ্যাসাগরের ভারী ইচ্ছে হল মা’কে গয়না পরাবেন। তিনি তখন সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ। মাস গেলে মাইনে পান ৩০০ টাকা। মা’কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘কেমন গয়না তোমার ভাল লাগে?’ভগবতীদেবী উত্তরে বললেন, তিনটি গয়না গড়িয়ে দিতে হবে।মা তিনিটি গয়না চাওয়ায় বিদ্যাসাগর তো মহা খুশি। এত দিন পর মা’কে কিছু দেওয়ার সুযোগ হয়েছে! ছেলে জানতে চাইলেন, মা, কী কী গয়না?মা জানালেন, ‘‘গ্রামে একটি অবৈতনিক স্কুল, দাতব্য চিকিৎসালয়, আর একটি অন্নসত্র প্রতিষ্ঠা করো।’’পরের দিন বিদ্যাসাগরকে দেখা গেল অন্য ভাইদের সঙ্গে কোদাল হাতে মাটি কোপাচ্ছেন তিনিও। স্কুলবাড়ির ভিত তৈরি করতে হবে যে! মায়ের প্রথম গয়না!

ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় তখন কাশীতে রয়েছেন। বিদ্যাসাগর মা’কেও পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু কাশীতে এসে ভগবতীর মনখারাপ। বিমর্ষ স্ত্রী’কে দেখে ঠাকুরদাস জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘কী হয়েছে?’’উত্তরে ভগবতী জানালেন, বীরসিংহের দরিদ্র মানুষগুলির জন্য মন কেমন করছে। মনে হচ্ছে কত দিন নিজের হাতে রেঁধে খাওয়ানো হয়নি ওঁদের।ভগবতী বলতেন, ‘‘বীরসিংহ আমার কাশী, সেখানেই আমার বিশ্বেশ্বর।’’নিজের ঠাঁই, তাঁর মানুষজনকে এ ভাবেই ভালবাসতেন ভগবতীদেবী।

নাতি নারায়ণচন্দ্রকে নিয়ে কলকাতায় আসছেন ভগবতী। কিছু দূর যেতে না যেতেই কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছেশুনে থমকে দাঁড়ালেন। নাতি নারায়ণচন্দ্রকে পথের ধারে বসিয়ে রেখে কী হয়েছে দেখতে গেলেন। সামনেই একটি গৃহস্থ বাড়ি থেকে কান্নার আওয়াজ আসছে। ভগবতী গেলেন সে-বাড়ি। দেখলেন পরিবারের এক ছেলের মৃত্যু হয়েছে। গোটা বাড়ি তারই শোকে কান্নায় ভেঙে পড়েছে। কলকাতায় যাওয়া মাথায় তুলে সম্পূর্ণ অপরিচিত সেই পরিবারের সঙ্গে শোক ভাগ করে নিতে ভগবতীদেবীও হয়ে পড়লেন তাঁদের সঙ্গী।ও দিকে পথেই বসে থাকল তাঁর নাতি নারায়ণচন্দ্র।

রবীন্দ্রনাথ যথার্থ বলেছেন, সকল সংহিতার অপেক্ষা প্রাচীনতম সংহিতা তাহাঁর হৃদয়ের মধ্যে স্পষ্টাক্ষরে লিখিত ছিল। তাই এমন কঠিন পরিস্থিতির অনেক সহজ সমাধান তিনি করতে পেরেছিলেন। আর সেই জন্য এই মহীয়সী দেবীর উদ্দেশ্যে আমাদের থাক শত কোটি প্রণাম।