এক নজরে

মিতালি এক্সপ্রেস

By admin

November 24, 2022

আমার পরিচিত উত্তরবঙ্গের নিরানব্বই ভাগ মানুষের কোনো না কোনো ভাবে বাংলাদেশ যোগ আছে।কারো বাবা-মা ,ঠাকুরদা-ঠাকুমা বা দাদু-দিদার জীবনের কিছুটা সময় কেটেছে বাংলাদেশে, আসলে বাংলাদেশেও নয়। পূর্ব পাকিস্তানে বা যখন অখন্ড ভারত ছিল তখন ওই অঞ্চলে বিরাট এই দেশটাকে কেমন যেন আধ-খ্যাঁচড়া করে ভাগ-বাটোয়ারা করা হয়েছে, তাই না?

তাই অনেকেই মনে মনে এই ইচ্ছে পোষণ করেন যে একবার অন্তত বাংলাদেশ গিয়ে ঘুরে আসব। এটা ঠিক বিদেশ ভ্রমণের মতো নয়, অনেকটা ‘দেশের বাড়ি’ যাওয়ার মতো। যদিও একটি বিদেশ ভ্রমণের সমস্ত রকম ক্রাইটেরিয়ার মধ্য দিয়েই আপনাকে যেতে হবে। পাসপোর্ট ভিসা লাগবে, মানি এক্সচেঞ্জ করতে হবে এবং নির্দিষ্ট জায়গায় ইমিগ্রেশনের জন্য‌ও হাজির হতে হবে।

আপনার ভিসাতেই উল্লেখ থাকবে আপনি সড়ক, রেল নাকি আকাশ বা সব ক’টি পথে ভ্রমণের সুবিধে পাবেন। আমাদের কুচবিহার জেলার মানুষজনের জন্য চ্যাংরাবান্ধা-বুড়িমারী বর্ডার দিয়ে বাস- যোগে বাংলাদেশে প্রবেশ সবচেয়ে সহজসাধ্য। কিন্তু আমার মতো ছিটেল যদি কেউ হয় এবং বাস যাত্রা এড়াতে চান, তাহলে মিতালি এক্সপ্রেস তাদের জন্য উত্তম অপশন।

এ বছর জুন মাসে তখন মিতালি এক্সপ্রেস পুনরায় পরিষেবা চালু করে(১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এই রুট পুনরায় ৫৬ বছর পর ২৭ শেষ মার্চ, ২০২১ অনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়)। তখন‌ই ঠিক করেছিলাম এই ট্রেনে চেপেই বাংলাদেশ যাবো। নিউ জলপাইগুড়ি টু ঢাকা। পুজোর ছুটির দিনগুলো কাছে আসতেই আমার ভিতর উত্তেজনার পারদ চড়ছিল। কুচবিহারে বসেই ভিসা, মানি এক্সচেঞ্জ‌‌ হয়ে যায় কিন্তু এই ট্রেনের টিকিট কাটতে হয় নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকেই। অনলাইন ব্যবস্থা নেই। টিকিট কাটার সময় আইডি প্রুভ কাগজ পত্রের সঙ্গে থাকতে হবে।

মিতালি এক্সপ্রেস ট্রেনের কামরাগুলো এসি। রয়েছে তিন ধরনের টিকিট। নিজেদের পছন্দ মত টিকিট কাটলেই হলো। সপ্তাহে দু’দিন রবিবার ও বুধবার সকাল ১১-৪৫-এ নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ছেড়ে রাতে ঢাকা পৌঁছয় ট্রেনটি। সব যাত্রীকেই নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে ইমিগ্রেশন করিয়ে ট্রেনে উঠতে হয়। ইমিগ্রেশনের জন্য ট্রেন ছাড়ার দু’ঘন্টা আগে স্টেশনে রিপোর্টিং করতে বলা হয়। যদিও ইমিগ্রেশন খুব সহজ ও স্বল্প সময়ের ব্যাপার।

৫ অক্টোবর অর্থাৎ বিজয়া দশমীর দিন আমরা এই ট্রেনে চেপে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিই। ট্রেন ঠিক সময়মতো ১১-৪৫-এ ছাড়ে। বলা বাহুল্য এই যাত্রা আমার কাছে যথেষ্ট ভিন্ন অনুভূতির সঞ্চার করেছিল। নতুন দেশ,  এতোদিনে পরিচিত কিন্তু না-দেখা মানুষজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবার এক অলৌকিক আলোর সামনে দাঁড়িয়ে আমি যেন উদ্ভাসিত হচ্ছিলাম। কিছুটা কল্পনা কিছুটা বাস্তবের অমেয় সিঁড়ি বেয়ে দ্বিধাজড়িত উঠে যাওয়া।

রানীনগর, জলপাইগুড়ি টাউন স্টেশন হয়ে হলদিবাড়ি। তারপর‌ই বর্ডার ক্রস করে বাংলাদেশের প্রথম স্টেশন চিলাহাটি। এখানে ট্রেনটা কিছুক্ষণ দাঁড়ায় । হয়তো আন্তর্জাতিক ট্রেন বলে কিছু ফর্মালিটিস থাকে আর ট্রেনে ক্যাটারিং ফেসিলিটি দিতে লোকজন এখান থেকে‌ই ঢাকা পর্যন্ত সঙ্গ দেবে আপনাকে। এরপর একে একে পার্বতীপুর , নাটোর , সান্তাহার জংশন আরো অনেক ছোট-বড় স্টেশন পার করে আমরা রাত এগারোটাও পর (আরো আধ ঘন্টা রাতে চলে যান বাংলাদেশের সময় অনুযায়ী) ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে নামি। দেখি, প্রত্যাশা মতো আমার প্রিয়জনেরা সেখানে দাঁড়িয়ে আছে, যাদের সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক নেই, কেবল আত্মার সম্পর্ক। বলুন এরপর‌ও কি চোখের পাতা একবার‌‌ও ভিজে উঠবে না?