ঘুরে-ট্যুরে

জঙ্গল সবুজ, মানুষগুলো আরো বেশি

By admin

September 21, 2020

(তৃতীয় পর্ব)

পৌলমী ভৌমিক। ছবি: শুভব্রত গায়েন।

গন্তব্য চেরাপুঞ্জি

মেঘালয় এসে চেরাপুঞ্জি আসেননি, এমন লোক সম্ভবত কমই হবে। ঝর্না, গুহা, পাহাড় মিলিয়ে প্রকৃতি যেন তার সবটা সবুজ উজাড় করে দিয়েছে। চেরাপুঞ্জির কথা তাই আর বিশদে লিখলাম না। এক সময় এখানেই নাকি বৃষ্টি হতো সবচেয়ে বেশি। এখন অবশ্য তার জায়গা নিয়ে নিয়েছে মৌসিনরাম।শুধুমাত্র একদিন আমরা বয়স্কদের জিম্মায় বাচ্চাকে রেখে, কর্তা, গিন্নী মিলে একটা ট্রেকে গিয়েছিলাম – trek to double decker root bridge। সে গল্প না-হয় পরে কখনো হবে। এবার আসি, মেঘালয় ট্যুরের আমাদের শেষ গন্তব্য – মওলংবাঁ (Mawlyngbna) গ্রামের কথায়।অনেকে বলে ‘ফসিল পার্ক’।

মওলংবাঁ কমিউনিটি প্রকল্প

চেরাপুঞ্জি থেকে গাড়িতে প্রায় ঘন্টা তিনেকের পথ মৌসিনরাম। সেখান থেকে আরও এক ঘণ্টা মওলংবাঁ (Mawlyngbna) গ্রাম। এখানে খাসি পাহাড়ের রূপ যেন জয়ন্তিয়া পাহাড়ের থেকেও বেশি আকর্ষনীয়। পাহাড়ী চওড়া রাস্তা বেয়ে ওপরে ওঠা। মওলংবাঁ গ্রামের মাথায়, এক্কেবারে পাহাড়ের মাথায় একটা জঙ্গল। আর এই জঙ্গলের ভেতর “Mawlyngbna Traveller’s Nest”। গাড়ি এসে দাঁড়ালো একটা সুন্দর বাড়ির সামনে। এটাই এদের অফিস ঘর আর সাজানো ডাইনিং রুম। হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানাল Beshyam। বয়স ২০ থেকে ৩০-র এক ছেলে। বয়সটা নিশ্চিত নই। মেঘালয়ে আসা ইস্তক সকলকেই যুবক ঠেকছে। এদের বয়স বোঝা ভার। “Mawlynhbna Traveller’s Nest”, আসলে এই গ্রামের কমিউনিটি প্রজেক্ট। গ্রামের ছেলে আর সঙ্গে তাদের বৌযেরা মিলে পরিচালনা করে। রান্নাবান্না ও বাকি কাজকর্মও নিচে গ্রাম থেকে লোকজন এসে করে চলে যায়। অফিস রুমের পাশে একটা ওয়াচ টাওয়ার। সেখান থেকে যতদূর চোখ যায় দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ প্রান্তর। তাদের কাছ থেকে শুনলাম শুনলাম ওটা বাংলাদেশের সমতল এলাকা।ডাইনিং রুমটিও দেখার মতন – চারিদিক খোলা। চা পর্ব শেষ করে কটেজের দিকে যাবার পালা। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেছে রাস্তা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। ডানদিকে পরপর তিন-চারটে কটেজ বেশ দূরে দূরে। জঙ্গলের নিস্তব্ধতা এমন, যেন নিজের হৃৎপিণ্ডের শব্দও শোনা যাচ্ছে। গাছে গাছে ঝোলানো বেতের ওয়েস্টবিন। রাস্তায় অবিশ্বাস্য পরিচ্ছন্নতা। এতদিনে এই রাজ্যের এই বৈশিষ্ট্যের সাথে আমরা পরিচিত হয়ে গিয়েছি। বেলা হয়েছে জলদি স্নান পর্ব সারতে হবে। এই জঙ্গলের মধ্যে এত সুন্দর রুম, ওয়াশরুমে গিজার – এ যেন অকল্পনীয়। কারা সামলায় এতো বড় জায়গা? উত্তরে, আবার অবাক হবার পালা – গ্রামের লোকেরাই পালা করে করে সব।

ভরসা পেয়ে বয়স্করাও ধরলো লাঠি, চললো ট্রেকিং -এ

লাঞ্চ সেরে বড়রা ভাবলেন একটু বিশ্রাম নেবেন।আর আমরা ভাবছিলাম চারপাশটা ঘুরে দেখবো। তখনই দেখলাম হাজির Beshyam ও তার দল। বলে, একটা ছোট্ট ট্রেক করলে একটা খুব সুন্দর ঝর্ণা দেখা যাবে – Um Di Kain। বড়দের তেমন উৎসাহ ছিল না। বেশ ক্লান্ত তারা। কিন্তু এই ছেলেপুলের উৎসাহ আমাদের থেকে অনেক বেশি। তারা চায় আঙ্কেল-আন্টিরাও দেখুক তাদের গ্রামের সৌন্দর্য।আমাদের ওরাই বললো, বয়স্কদের ভাবনা ওদের। তারাই ধরে ধরে নিয়ে যাবে। কে জানে ওদের উৎসাহে না আমাদের মোটিভেশনে- হঠাৎ দেখলাম আমাদের প্রবীণ বাহিনী রেডি হয়ে লাঠি হাতে প্রস্তুত। পোস্ত ও দৌড়ে গিয়ে তাদের লাইনে দাঁড়ালো। শুরু হল পাহাড় আর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ট্রেকিং। ৫ বছর থেকে ৭০ বছর – সবার সমান উৎসাহ।জঙ্গলের পথ পেরিয়ে, একটা খোলা প্রান্তর – সেখানে সোনালী বড় বড় ঘাস। বিকেল – তাই সূর্যের তেজও কমে আসছে। বেশ খানিকটা হেঁটেই সামনে Um Di Kain falls। সময়টা পূজোর পর, তাই জলের গর্জন বেশ ভয়ঙ্কর। অবাক হয়ে ঝর্না দেখছি, হঠাৎ ঝপাং করে একটা শব্দ। দেখি সঙ্গের ছেলেরা জামা খুলে উপর থেকে ঐ পরিষ্কার জলে, দিয়েছে ঝাঁপ। সাঁতরে চলেছে, আর নিজেদের ভাষায় বোঝাবার চেষ্টা করছে, তাদের গ্রামটা কত সুন্দর।বিকেল গড়িয়ে আসছে। তাই আর ঝুঁকি না নিয়ে বয়স্কদের ফেরত পাঠিয়ে আমরা রওনা দিলাম Luri Lura – সেখানে পাথরের গায় নানারকমের জন্তুর ফসিল-ছাপ। মেঘালয়ের রূপকথা অনুযায়ী এখানে জীবজন্তুরা একত্রিত হয়ে বাজার করতো। সত্যি মিথ্যার বিচার না করে জায়গাটার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করাটাই শ্রেয় মনে হলো। ওদিকে সন্ধে হয়ে এসেছে। প্রায় কিছুই চোখে দেখা যাচ্ছে না। Beshyam বললো, ওরা অনেকগুলো ফসিল সংগ্রহ করে রেখেছে।কাল দিনের আলোয় দেখাবে। ফেরার পথে পুরো অন্ধকার নেমে গেলো। মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে ওই জঙ্গলের পথ দিয়ে ফেরা। সে এক অন্যরকমের অভিজ্ঞতা। তবে এই জঙ্গল খুবই নিরাপদ– হিংস্র জীবজন্তু নেই বললেই চলে।

বাপ রে বাপ, এটাই বুঝি চেরাপুঞ্জির বৃষ্টি !

সন্ধেবেলা চা খেতে খেতে রান্নাঘরের বাইরে বসেছি। সামনে পাহাড়টায় মিটমিট করছে অজস্র আলো। নিচে মওলংবাঁ গ্রাম। শুনলাম গোলমরিচ ওদের ওখানে প্রচুর চাষ হয়। Beshyam বললো কাল সকালে আমাদের এনে দেবে।রাতে জমাটি ডিনার সেরে, মা বাবাদের তাদের কটেজে পৌঁছে দিযে নিজেদের কটেজে ফেরত এলাম। জঙ্গলের নির্জনতা, দূরে ঝর্নার শব্দ – উপভোগ করতে বারান্দায় বসেছিলাম। ছেলে ঘরে ঘুমোচ্ছে। এমন সময় হঠাৎ আকাশের বুক চিরে বিদ্যুৎের ঝলকানি। হুড়মুড় করে নেমে পড়ল তুমুল বৃষ্টি। বড় বড় গাছের পাতায় পড়া সে বৃষ্টির শব্দ কি ভয়ংকর – অথচ কি নেশাতুর। সত্যি সত্যিই নেশা ধরে যায়। কয়েকটা গাছে আলো লাগানো থাকায় জঙ্গলের ভেতরের রাস্তাটাও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে – বৃষ্টিতে সাদা। পাশে তাকিয়ে দেখি, বাবারাও কটেজের বাইরে চেয়ার নিয়ে বসেছে। সারারাত চললো সেই ভয়ঙ্কর বৃষ্টি। মাঝে মধ্যে ভয়ও হচ্ছে। যেন মনে হচ্ছে আজই ভেসে যাবে এই সভ্যতা। এই কি তবে মেঘালয়ের বিখ্যাত বৃষ্টি! এই কদিন মাঝে মধ্যে বৃষ্টি পেলেও, এভাবে সারারাত ভয়ঙ্কর বৃষ্টি এই প্রথম। মেঘালয় ট্যুরের এটাই ছিল আমাদের শেষ গন্তব্য। তাই বোধহয় প্রকৃতি আমাদের এই বৃষ্টির সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দিলো।

নেশা ধরাচ্ছে ভীষণ সবুজ, ভয় ধরাচ্ছে কালো মেঘ

সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেলো। তখনও চলছে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। বাইরে বেরিয়ে দেখি সারারাত বৃষ্টিতে ভিজে জঙ্গল যেন আজ আরও ভয়ংকর সবুজ। Beshyam ও তার ছেলেরা ঘরে পৌঁছে দিল ধোঁয়া ওঠা চা-বিস্কুট।রেডি হয়ে ব্রেকফাস্ট করার জন্য ওপরের ডাইনিং রুমে গেলাম। পাশের ওয়াচ টাওয়ারটা থেকে বাংলাদেশের সমতল জমি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দেখি দূর থেকে কালো মেঘ যেন আমাদের দিকেই ধেয়ে আসছে। ভয়ংকর কালো দৈত্যের মতো সেই মেঘ। বইয়ে পড়েছি আজ চোখের সামনে দেখে বেশ একটু গা ছমছমই করল। চলে এলাম ব্রেকফাস্ট টেবিলে। টোস্ট, বাটার, ডিমের অমলেট আর এক রাউণ্ড চা দিয়ে পুরো ইংলিশ ব্রেকফাস্ট সেরে মালপত্র গাড়িতে তোলার পালা। যাবো উমখাকোই লেক দেখতে। Beshyam রা নিয়ে এসেছে কাঁচের বাক্সে সংগ্রহ করা ফসিল। নিচের গ্রাম থেকে এসেছে গোলমরিচ আর মধু। সেসব গুছিয়ে, গাড়ীর মাথায় ব্যাক্স প্যাঁটরা বেঁধে চললাম উমখাকোই লেক দেখতে।বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে আবার। একদিকে পাহাড়, অন্যদিকে খাদ ঘন মেঘে ঢাকা। হুহু করে মেঘ চলে আসছে – ঢেকে দিচ্ছে রাস্তা – কাঁচ খোলা থাকলে ঢুকে পড়ছে গাড়িতে। ড্রাইভারের অভিজ্ঞতাই ভরসা। নাহলে এই মেঘের প্রাচীর কাটিয়ে উনি কি করে সামনের রাস্তা দেখছেন জানিনা! এই তবে মেঘের দেশ মেঘালয়ের বৃষ্টি! মেঘেদের আনাগোনা নয়, রীতিমত হানা।

মওলংবাঁ-র অন্যতম আকর্ষণ উমখাকোই লেক

উমখাকোই ওয়াটার রিসার্ভার – এরম অদ্ভুত জায়গা কখনও দেখিনি। লেকের চারিদিকে বিশাল বিশাল গর্ত, তার মধ্যে জল। লাফিয়ে লাফিয়ে একদিক থেকে অন্যদিকে যাওয়া। লেকে বোটিং-র দারুন ব্যবস্থা। মধ্যে মধ্যে ছোট্ট ব্রিজ – আমার পাঁচ বছরের পোস্তর সে কি আনন্দ! ছাতা মাথায় দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, ওর ভাষায় “ফুটো লেক”এর চারধারে। সত্যিই প্রকৃতির থেকে বড় চমক কেউ দিতে পারে না। কে এভাবে এতো বড় বড় গর্ত করে রেখেছে পাথরে – যার জন্য এই লেক হয়ে দাঁড়িয়েছে ইউনিক। মনে মনে কুর্নিশ জানাই তার উদ্দেশ্যে। তবে উমখাকোই লেক না দেখলে বোধহয় মিস হয়ে যেত মওলংবাঁ-র অন্যতম আশ্চর্য সৃষ্টি দেখা।এবার বিদায় নেবার পালা। যাবো শিলং। কাল সকালে গুয়াহাটি থেকে ঘরে ফেরার ট্রেন। গাড়িতে বসে বসে ভাবছিলাম, মওলংবাঁ গ্রাম মেঘালয়ের প্রায় শেষ প্রান্তে – বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি। এতটা প্রত্যন্ত একটা জায়গায় ঘুরে এলাম অথচ কারো কোনও অসুবিধা হল না। কারো কোনও অভিযোগও নেই। মনে পড়লো Beshyam-দের হাসি মুখগুলো। ওদের নিরন্তর চেষ্টা যাতে আঙ্কেল আন্টিদেরদের অসুবিধা না হয়। ট্রেকের সময় যখন আমি পোস্তকে নিয়ে হিমসিম খাচ্ছি তখন এক ঝটকায় ওকে পিঠে তুলে নিলো। সঙ্গে এক গাল হাসি – মুখে “দিদি” বলে কি বলল বুঝলাম না। মনে হল এটাই বলছিলো – “দিদি, আমরা তো আছি”। এই আন্তরিকতা, মানুষের সারল্য, সদা হাস্যময় মুখ যেন পুরোপুরি ভাবে মিলেমিশে গেছে সবুজ প্রকৃতির সঙ্গে।

আলোচনায় অনুভবে হলুদ আন্তরিকতা

আজও যখন ওই দক্ষিণ কলকাতার ডাইনিং রুমে বসে মেঘালয় ট্রিপের প্রসঙ্গ ওঠে, সবাই এক বাক্যে স্বীকার করি – কি পরিষ্কার! কি হাসিমুখ! কি সবুজ! কি শান্তি! নিজেদের কাছে নিজেরাই শপথ করেছি, আবার যাবো মেঘালয়। খাসি আর জয়ন্তীযা দুটো পাহাড়ের রেঞ্জ দেখেছি। গারো পাহাড় তো যাওয়াই হয়েনি। পরিবারে সবার বয়স বেড়েছে কালের স্বাভাবিক নিয়মেই। দু’বছর হলো শশুরমশাইও আর নেই। তবু মেঘালয়ের আকর্ষণ কারোর কাছে এক ফোঁটা ফিকে হয়েনি।২০১৮ তে ফিরে আসার বেশ কদিন পর ইয়ালাং পার্কের পরীক্ষিত বাবুর একটা ফোন এলো। ফোনের ওপার থেকে ভেসে এলো তাঁর স্বর– “সেবার মাইজিদের আমাদের বিখ্যাত হলুদ দিতে পারিনি।একটা কাজে কলকাতা এসেছি। দু’বাড়ির জন্য দুই প্যাকেট হলুদ এনেছি আমাদের ওখানকার। একটু দেখা করে নিয়ে নেবেন?”এদের কি কখনও ভোলা যায়?

শেষ…