সুতপা সাহা | ছবি: কৌশিক মুখোপাধ্যায় ও কৌস্তভ খান
এখন না হয় লক ডাউন চলছে। তা সে তো উঠবেই, আজ হোক বা কাল।ইট-কাঠ-সিমেন্টের জঙ্গলে থাকতে থাকতে যদি হাঁফিয়ে ওঠে আপনার শরীর-মন, তবে প্রকৃতির আপন খেয়ালে বানানো শাল, পিয়াল, পলাশের জঙ্গলে ঘেরা মাঠাবুরুতে দু-একটা রাত কাটিয়ে এলে আপনার অবসন্ন মন আবার উজ্জীবিত হয়ে উঠবে একথা হলফ করেই বলা যায়।
পুরুলিয়া জেলার বাঘমুন্ডি থানার অন্তর্গত এই মাঠাবুরু পাহাড়। মাঠা রেঞ্জ জঙ্গলের মধ্যে। অযোধ্যা পাহাড় রেঞ্জের পাহাড় মাঠাবুরু। দুহাজার ফুট উঁচু ফণা তুলে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে। বুরু মানে পাহাড় বা টিলা। বনপাহাড়ির দেবতা থাকেন মাঠাবুরুর চূড়োয়। এই পাহাড় চূড়োয় রয়েছে তাঁর মন্দির, আদিবাসীদের মন্দির। বছরের বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রূপ মাঠার। তারই আকর্ষণে পর্যটকের ঢল নামে এই পাহাড়ে। বর্ষাকাল ছাড়া সারাবছর এখানে ট্রেকিং হয়। সামান্য রক্ ক্লাইম্বিং করে একেবারে এর মাথায় চড়া যায়। চড়ার পথে মাঠাবুরুর আদিম রূপ চোখে পড়বে। ৪০/৫০ ডিগ্রি খাড়াই পথ আর পাথর পেরিয়ে, প্রায় বালি হয়ে যাওয়া পাথুরে মাটিতে পা হড়কে যেতে পারে যখন তখন। খুব সাবধানে গাছের ডাল ধরে ধরে শেষে এর শীর্ষে পৌঁছানোর পরে কানের পাশ দিয়ে উড়ে যাবে মেঘ। আর তখনই জুড়িয়ে যাবে মনপ্রাণ।
তবে সাধারন পর্যটকদের কাছে শীতে এর আকর্ষণ ভিন্ন স্বাদের। ভোরে কুয়াশায় ঢাকা মাঠাবুরুর পথে যেতে যেতে পুরুলিয়ার জাঁকিয়ে বসা শীতের অনুভূতি অন্যরকম। এই শীতে পাথুরে পথ আর ছোট-বড় জঙ্গল পেরিয়ে চূড়োয় ওঠার পথে অরণ্যের রূপ-রস-গন্ধ মনকে মাতিয়ে তোলে। ওপরে উঠে চারিদিকে তাকালে দেখা যাবে পাহাড়ের ঘেরাটোপ। মাথার ওপরে নীল আকাশ, সে এক অনাবিল সৌন্দর্য। বাঁদিকে অযোধ্যা পাহাড়, ডানদিকে দলমা রেঞ্জ, ঝাড়খন্ড সীমানা। দূরে দেখা যায় চান্ডিল ড্যাম। আর পুরুলিয়ার বিখ্যাত ছৌ নাচ! সেই ছৌ নাচের মুখোশ তৈরির গ্ৰাম, চড়িদা! দেখা যায় অদূরে। সব মিলিয়ে মন ভরপুর হয়ে উঠবে।
বসন্তে মাঠাবুরু সেজে ওঠে তার যৌবনের সাজে। হাজার হাজার গাছের পলাশের বন। লাল আগুন যেন ধরিয়ে দেয় পাহাড়ের সর্বাঙ্গে।পাহাড়ের এবড়ো খেবড়ো পাথুরে বুকে সবুজ বাদামী ঝরা পাতার ওপর বিছানো লাল পলাশ যেন রঙিন কার্পেট। ওপরে নীলাকাশ, সেখান থেকে আসা সোনাঝরা রোদ, আর নীচে সবুজ বন, সব মিলিয়ে এক মোহময় আবেশ ছড়িয়ে থাকে মাঠার আনাচে কানাচে। চলতে চলতে মাঝে মাঝে হাতির পায়ের ছাপ চোখে পড়তে পারে। মাঠা পাহাড়ে হাতির আগমন ঘটে থাকে মাঝে মধ্যেই। পাহাড়ের চূড়ায় উঠে মাঠাদেবতার মন্দিরের সামনে এসে মনে হবে উদভ্রান্ত এক আদিম যুগে পৌঁছে গেছি।
মাঠাতে একটা বিশেষ দিন হল পয়লা মাঘ। পৌষ সংক্রান্তির পরের দিন, উত্তরায়ন শুরুর দিনে মাঠা পাহাড়ে মাঠা দেবতার পূজোর উৎসব। হাজার হাজার মানুষের স্রোতে, ঝুমুর নাচ, আর ধামসা মাদলের সুরে সাঁওতালি নাচে জমে ওঠে মাঠার আকাশ বাতাস। আদিবাসীরা তাদের মনস্কামনা পূর্ণ হলে মাঠাদেবতার উদ্দেশ্যে পশুবলি দিয়ে থাকে সেই সময়। তখন পাহাড়ের নিচে মেলা বসে। মেলায় সবচেয়ে আকর্ষনীয় আইটেম ছৌ নাচের মুখোশ।
এতো গেল দিনের আলোয় বিভিন্ন সমযে মাঠার সৌন্দর্য। কিন্তু জ্যোৎস্না রাতে মাঠার সৌন্দর্য ভোলা যায় না। চাঁদনী রাতে মায়াবী আলোয় মাঠাকে দেখার রোমাঞ্চকর অনুভূতি অতুলনীয়।তখন মাঠা যেন রহস্যময়ী রাতপরী। গোটা অঞ্চল ভেসে যায় জ্যোৎস্নায়। রাতে পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে মাঠার ফরেস্ট বাংলোয় থাকতে হবে। ফরেস্ট বাংলোর পাশে শৈলারোহন শিক্ষার্থীদের তাঁবুতে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে মাঠা গ্ৰামেও কারো কারো বাড়ীতে রাত কাটানোর ব্যবস্থা আছে। এখন সেখানে তৈরি হয়েছে ট্রি হাউস এবং রয়েছে তাঁবুতে থাকার ব্যবস্থাও। দিনরাত মিলিয়ে মাঠার রূপ স্বচক্ষে দেখতে মাঠাতে তাই একবার আসতেই হবে আপনাকে।
যাত্রাপথ: হাওড়া থেকে রাতের চক্রধরপুর ট্রেনে চেপে ভোরে বরাভূম স্টেশনে নেমে গাড়ীতে করে মাঠা পৌঁছে যাবেন। মাত্র ১৭ কিমি স্টেশন থেকে মাঠাবুরু।